Monday 18 April 2016

আমিই সেই আহীরী

আমিই সেই আহীরী
এক
ঘরের দুটো জানলাই কখনও একসঙ্গে খুলে দিই না আমি। সহ্য করতে পারি না প্রেসক্রিপশান-বহির্ভূত অতটা আলো, যারা তাদের দোলখাওয়া সবুজ ঘরবাড়ি থেকে ছুটে এসে আমার চোখের তারাদুটো খেয়ে নেবে, মমি বানিয়ে দেবে মুখটাকে।
কিন্তু আজ নিরপরাধ অঘ্রাণ-সকালের হলুদ দীপ্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি হাট করে দিলাম আমার দ্বিতীয় ফুসফুস। হেমন্তের মচকা তাত শরীরে এসে লাগল। সুতো-সুতো খুশি জড়ালো ঘুমহীন হাসপাতালে ছোটা থেকে অফিসের পেপার-ওয়েটের নিচে চাপা পড়া এ-পর্যন্ত আমার সবক’টা আত্মায়।
আমার মনে পড়ল তোমাকে।
নাকি তুমিই ছুটে এলে আমার ভেতরে, অতীতসঞ্চার? যেমন বেড়াতে নিয়ে যাবে শুনলে এ-কোল থেকে ও-কোলে ঝাঁপিয়ে যায় শিশু!
দুই
আজও শেষরাতের ঘুম ভেঙে ভারশূন্য ঋদ্ধিশূন্য মাথা অন্ধকার ঘরে ধড়মড় করে উঠে খাট থেকে পা নামিয়ে চপ্পল খোঁজে। খুব দেরি হয়ে গেল, বুঝি! তোমাকে সকালের ফোন করতে হবে না? তারপর মনে পড়ে, সতীদাহ বা গুটিবসন্তের মতো বহুদিন সে-প্রথা আমরা নির্মূল করেছি। তখন মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকা কিছুক্ষণ। সকালের চলাফেরা একগাছি খড়ের বাঁধন খোলা পালংপাতার মতো বারবার এলিয়ে যেতে থাকে।
তিন
আজ এই হালকা গলা-ব্যথার রবিবার বাজারে গিয়ে মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম, নতুন ক’রে দেখে নিই ইতরের মুন্ডু ঝরে যাওয়া। তাকে দুজন লোক যখন দোকানের বধ্য-বারান্দায় নিয়ে আসছে, খাসির ভাঙা গলার চিৎকার হ’ল নষ্ট হওয়ার আগে সম্পর্ক তাক করে ছোঁড়া কাচের শেষ বাসনগুলো। এবার ছুরিতে দুফাঁক ক’রে দেওয়ার পর গলার নলির একমুঠো টগর আর চারপাশে রঙ্গনের উৎসারিত ঢেউ তার সারা শরীরে গণবিক্ষোভ ও সত্যাগ্রহের জন্ম দিচ্ছে, মণিপুরী নগ্ন মেয়েদের আইন অমান্যের মতো। এখন শক্ত করে ঠেসে ধরা চাই আমার শরীর --- দুটো পা সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে দিন, এবং আরেক মনোবিদের কাজ হল নজরে রাখা পেশেন্টের হাত দুখানাও যেন খোলা বাতাসে ছড়িয়ে না যায়। লক্ষ করুন, এই প্রতিরোধের ডোজ একদম ঠিকঠাক পড়েছে বলেই আমার ক্রমহ্রাসমান তলপেট এখন নিজের রক্তের বিছানায়, যার ওপর ওই রক্তেরই বেডকাভার, আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়তে আগ্রহী। বিড়বিড় করে বলছে ‘শান্তি, আত্মসমর্পণ’, কিন্তু চালচিত্রে একটা সাদা পতাকার অভাবের জন্যে কেউ আমার সন্ত্রাসবিরোধী মনোভাবে খুব একটা আস্থা রাখতে পারল না --- না চিকিৎসক, না সাইকোথেরাপিস্ট। শেষপর্যন্ত গায়ের লোম খ’সে, চামড়া খুলে যখন ছাগল থেকে এক নির্মীয়মান খরগোশের দিকে চলে যাচ্ছি, এই প্রাণকে তামাদি ঘোষণা করা হয়। কারণ জীবন মানেই ‘ইশ্‌ছা’, যেমন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস বলেছিল, সুতরাং অসন্তোষও, আর সেখান থেকে জন্ম নেওয়া পালটা-আক্রমণ। অন্যদিকে অসুস্থতা মোক্ষের কাছাকাছি, এবং মরণ হল পরমগতি। যে মরহুম, ধরে নেওয়া হচ্ছে তার ব্যাধিও মারা গেছে। তাই অভিযুক্ত টেঁসে গেলে প্রশাসন যাবতীয় অপরাধের তালিকা ও শাস্তির সুপারিশ ফিরিয়ে নিয়ে থাকে।
কিন্তু অনেক সময় আলাদা কিছু ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। যেমন, আমাকে সুশ্রীমতো ধুয়ে-মুছে উলটো করে বাস্তবের মাটিতে লটকে দেওয়ার পরেও দেখা গেল, যেখানে আগে কলিজা ছিল এবং বর্তমানে লেপচাজগত-এর আচমকা ধসনামা শূন্যতা, তিরতির করে কাঁপছে সেই সিনাঅঞ্চল। কাজেই, শিশুদিবসের সকালের বাচ্চারা তাদের অভিভাবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, “দ্যাখো বাপি, কতক্ষণ বেঁচে আছে ছাগলটা”! জীবিত থাকার ছদ্মবেশে এই চিউইংগাম কায়দায় দেহত্যাগ মেগা সিরিয়ালকেও লজ্জা দেবে ব’লে তৈরি, যখন গ্যাস ওভেনের উপর কড়াইতে খাসির ঠ্যাং ছেড়ে দিয়ে সভয়ে পিছিয়ে আসে বাড়ির নতুন বউ, “ও মাগো, এখনও নড়ছে যে”!
এই লেখাটাকেও এক জাতিস্মর স্নায়ুতাড়না ভাবতে পার তুমি।
চার
খুব মনে পড়ে, মনকষাকষি হলেই বলতে: আমাকে তুমি মোটেও ভালোবাসোনি। ভালোবেসেছ শুধু প্রেমের একটা আইডিয়াকে।
কিন্তু প্রেমকে প্রধানত ধারণা ছাড়া আর কীই বা ভাবতে পারি, বলো? যেন নার্সারি থেকে আনা গাঁদাফুলের চারা --- মাটিতে বসালে তবেই না সে উদ্ভিদ!
ধারণা আর আধার --- এই দুইয়ের যোগসাজসেই হয়তো সম্পর্ক গড়া হতে থাকে। স্বীকার করছি, নিজেকে কোনওদিন একতিল বাস্তবতা ভেবে শান্তি পাইনি, বরং হাতে-ধরা আমি-র চেয়ে আয়নায় প্রতিফলিত ছায়াই চিরদিন বেশি আদরের ছিল নিজের কাছে। এই শরীরকে যখন আত্মপরিচয়ের বদলে অঘ্রাণ মাস ভাবি, পাইনগাছের মাথার কুয়াশাপাগড়ি ভাবি, বা দু’পা পঙ্গু ভিখিরির ময়লা হাতের কয়েন একটাকা-দুটাকা, ফুরফুর করে ওড়ে কপালের ওপর আমার মাথার চুল।
সবাই জেনে গেছে, তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না কোনওদিন। দুটো মানুষ মনে-মনে ইচ্ছে না করলে তাদের তো ইহজীবনে দোকানদারি হয় না! তবু একটা পছন্দের রূপকথা আছে আমার, প্রেমের পেয়ারাডাল ভেঙে ধরাশায়ী সব প্রেমিকই বুঝি জাতিস্মর মোটর নিউরোনের তাড়নায় কেঁপে উঠে স্বপ্ন দ্যাখে --- প্রেমের ওপর সে নিজস্ব কায়দায় শোধ নেবে, ছোটবেলায় পড়া গল্পের গরীব গয়লানির মতো। মাথায় দুধের মট্‌কি নিয়ে মেয়েটা রোজ বাজারে যেত। তো, একদিন হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে, এই দুধ বেচে লাভ ক’রে আরও বেশি দুধ কিনে সেই দুধ বিক্কিরি করে অসীম মুনাফা অর্জনের পর সে এমন অনাস্বাদিতপূর্ব বড়লোক হয়ে যাবে যে দেশের রাজপুত্রও বিয়ে করতে চাইবে তাকে। কিন্তু মেয়ে তখন ঘচাং করে খারিজ করে দেবে নবাবজাদাকে। মাথা নাড়িয়ে বলবে, না না না ...।
আমিও ভাবি, কস্মিনকালে দেখা না হয়েও একদিন অকস্মাৎ মুখোমুখি পড়ে তো যেতে পারি আমরা। গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশানে? বেশ, তাই হোক।
তুমি এগিয়ে এসে ইতস্তত গলায় বললে, কেমন আছো!
রোগা হয়ে গেছ এতটা? নিশ্চয়ই না খেয়ে অফিসে চলে যাও?
আহা, আমার ওপর রাগ করে কবিতা লেখাই বন্ধ করে দিলে!
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম, যদিও আমার স্বভাব সিগারেট ও নীরবতাবিরোধী। তুমি আরও একটু অস্থির: আচ্ছা বাবি, সব ঝগড়া ভুলে আবার প্রথম থেকে শুরু করা যায় না! ধরো (গলা ধ’রে এসেছে) মাঝখানের দশ বছর মিথ্যে, দুজনে ফিরে গেছি শুরুর দিনটায়। তুমি আমার হাতে সদ্য বেরনো কবিতার বই তুলে দিচ্ছ, আর সেই আগের মতো আমি দেমাক দেখিয়ে বললাম, ‘পড়ব নিশ্চয়ই, কিন্তু মতামত দিতে অনুরোধ করবেন না, প্লিজ’!
না গো, বলব না। পুরনো ভুলগুলো আমরা কেউ করবো না আর কখনও, দেখো তুমি।
তখন মনে হল, আমার গায়ের রঙ পরিপক্ক চাপা, টলটলে স্বাস্থ্যের ওপর হলুদ ডুরে শাড়ির গাছকোমর। আমার মাথায় গাগরিভর্তি ছলছলাৎ। আর সামনে তুমি --- ফর্সা, উচ্চাকাঙ্খী এক অস্ত্রসমাবেশ! এবার বহু বছর ধরে রিহার্সিত সেই ছোট পংক্তির ডায়লগ বের করে আনছি চিত্রনাট্য থেকে, এক্সপ্রেশানে গন্ডোগোল না করে বসি, যেন প্রতিটা অক্ষরে সমান জোর পড়ে:
না বাবি, এখন আর সেটা সম্ভব নয়”।
বাক্য শেষ। এবার সান্নাটা! ড্রপসিন আপেলের মতো পতনমুখী। “এখন আর সম্ভব নয়” বলতে বলতে আকাশ থেকে পাখির ঝাঁক উধাও হচ্ছে। “সম্ভব নয়” --- যাত্রাপালায় ঝাঁঝর বাজল তুলকালাম “ঝং” করে। দন্ত্য স, ম আর অন্তস্থ য়-এর ভেতরের সেলাই খুলে গিয়ে তিনটে পোকায় কাটা আলাদা দাঁতের টুকরো...।
আমার মাথা থেকে খসে প’ড়ে, প’ড়ে চুরমার হয়ে, হ’য়ে ভরপুর মৃত্যুর মধ্যে মিশে যাচ্ছে ওরা দুজন --- ধারণাপূর্ণ দুধ আর মাটির কলসাধার।

সা রে গা মা পাক --- কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না

সা রে গা মা পা --- কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না
ভালো গাওয়া হ’লে ভালো গান, আগে যতবারই শোনা থাকুক না, আপনাকে মাতিয়ে দেবেই। “আকাশভরা সূর্যতারা”র ব্যাপারেও সেই এক কথা। দুর্নিবারকে আমরা কি এমনি এমনি ভালোবাসি? অন্তরা-য় (কৌশিকী বললেন, ‘প্রথম অন্তরা’, যদিও রবীন্দ্রসংগীতে অন্তরা একটাই হয় --- গানের দ্বিতীয় স্তবক) ‘জোয়ার-ভাঁটায় ভুবন দোলে’তে “ধনি -র্সনি –ধনি ধপা(‘ধা’ স্পর্শ স্বর)” --- এই স্বরগুচ্ছ ছেলেটা যে অলস খুশিতে গলায় তুলে আনল সেটা শীতের রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে দোতলার ছাদে বসা বনেদি বাড়ির মেয়ের সৌন্দর্য।
কিন্তু তুমি ওখানটায় কী করলে দুর্নিবার? সঞ্চারী থেকে আভোগে সঞ্চারিত হওয়ার মুখে ‘বিস্ময়ে তাই জাগে’-র ‘জাগে’-তে?
এই গানের কথায় ‘জাগে’ রয়েছে মোট চারবার, স্তবকের শেষে ধুয়োর মতো। আর, সুরে প্রত্যেকবার রিপিট করা হয়েছে ব’লে চার গুণ দুই, এইট টাইমস। আমি স্বরলিপিতে ‘জাগে’-র প্রথম উচ্চারণগুলো ধরে বলছি: অন্য তিনটে জায়গায় “মা -পা –ধপা পমা(পা স্পর্শ স্বর)” গেয়ে দিয়েছ, একদম ঠিক আছে। কিন্তু ওই তৃতীয় ‘জাগে’ ? ৩০ নম্বর স্বরবিতান খুলে দ্যাখো, সে জেগে আছে অন্যভাবে --- “গা -মা –পধা পমা”।
কেন আছে?
কারণ একটা হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ মহাশয় খুব সুবিধের লোক ছিলেন না। ‘আমি সোজা সুর করি, সব্বাই গাইতে পারবে’ বলে গায়ে ফুঁ লাগানো বাঙালিকে ডেকে-ডুকে গান তো ধরিয়ে দিলেন। তারপর একই কথার সুরের চলনেই এখানে-ওখানে উলটো প্যাঁচ মেরে আমাদের প্যাঁচে ফেলার ব্যবস্থাও সেরে রাখলেন সুন্দর রকম। আহা, সে পয়জার কঠিন কিছু নয়। কেননা, মরাল অফ দ্য স্টোরি এইটুকু, জলবৎ করে দিয়েছি মানে এই নয় তোরা আমার গানটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গাইবি। বাঙালি হ’ল বেসিক্যালি কীর্তন-প্রজাতি, একই ঝোঁকে চোখ বন্ধ করে ধুয়ো টেনে যেতে ভালোবাসে।
তাই আনমনা ড্রাইভারের জন্যে রাস্তায় ছোট্ট ক’রে দু’একটা স্পিডব্রেকার ফেলে রাখলাম, ব্যাস্‌।
কিন্তু এটা আমাদের পর্যালোচনা। রবীন্দ্রনাথকে জিগেস করলে উনি কি সহমত হবেন? চান্স খুব কম। আচ্ছা, সুরের গুরু কী বলছেন?
গানটা প্রথম থেকে লক্ষ করো। আকাশ, সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, অসীম কালের জোয়ার-ভাঁটা --- এদের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আমার গান সবিস্ময়ে জেগে উঠছে। এই আশ্চর্যতাও আকারে উদাত্ত, কিং সাইজ। সেই জন্যে মাঝ সপ্তকের পঞ্চম থেকে নির্দ্বিধায় ওপরে উঠে যাচ্ছে স্কেল বেয়ে; ঝটকা দিয়ে নেমেও আসছে --- পঞ্চমকে সিকিভাগ ছুঁয়ে মধ্যমে দাঁড়িয়ে পড়াটা ভাবো। কিন্তু যখন এই গানেরই সঞ্চারীতে ঘাসে ঘাসে পা ফেলার কথা বললাম, বনের পথ আর ফুলের গন্ধের ছবি এল, তখন ওই ম্যাক্রোকসমস-এ ছড়িয়ে নেই আমি আর, ছোট সূক্ষ্ম কোয়ান্টাম পৃথিবীর প্রতি অণুতে পা ফেলে হাঁটছি। সেখান থেকে উত্থিত আমার গানের যে অবাকপনা, সেটা কোজি, স্পর্শকাতর, মায়ামাখানো। তাই পঞ্চমের উচ্চতা নয়, গান্ধারের প্লুতস্বরকে শুরুর পৈঠা করছে সে। ফিরে আসতে গিয়ে ওই পঞ্চমেরই অর্ধেককে আঠালো পিছুটান মাখিয়ে রেখে এল। এই রহস্যময় মন্দ্রতা দিয়ে --- যেন কোনও বয়সিনী মেয়ে --- আমি আঁকতে চেয়েছি ভুবন-সঞ্জাত গানের জেগে ওঠাকে।
আবার দ্যাখো, গানটা ধাপে ধাপে উঠে ঘরের মায়া ছেড়ে ফের বৃহতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে --- যেখানে সে ধরিত্রী-র সঙ্গে একাত্ম হওয়ার পরে জানার ভেতর দিয়ে আবার অজানাকে পেতে চাইল, মানে একপাক ঘুরে এসে পড়ল আকাশ, নক্ষত্র, বিশ্বজগতের ভেতর। সেখানে বিস্ময় জেগে উঠেছে আবার প্রথমবারের মতো সাহসী, অতিব্যাপক।
হয়তো এতক্ষণ নিজের মনের খেয়ালে কথা তৈরি করে গেছি। তবু এটুকু তো সত্যি যে, কোনও কুমার বা কুমারীর সিডি অথবা এই প্যানেলের বিচারকেরা তোমার রবীন্দ্রসংগীতে সুরের ভুল ধরিয়ে দিতে পারবেন না। তাই নিজেকেই সাবধান হতে হবে, ভাইটি।
স্বরবিতান খুলে শিখে নেওয়াই বুদ্ধিমান শিল্পীর কাজ।

Saturday 16 April 2016

তিনচুলের দুয়োরে

তিনচুলের দুয়োরে
এক
শিয়ালদা থেকে দার্জিলিং মেলে উঠলে ফারাক্কা ব্যারেজ একটা মহালয়া! ভোর ঠিক পৌনে চারটেয় তোমার পিঠে গুম-গুম কিল মেরে ঘুম ছুটিয়ে দেবে। তারপর ট্রেনের সাদা কফিন-কাভারে শুয়ে রেলের চাকার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শুনতে শুনতে আবার নিদ্রা মেঁ তল্লীন হয়ে যাও!
সত্যিই কি গঙ্গা সেতু পেরনো গাড়ি আর চণ্ডীপাঠে কোনও তফাত আছে, যখন দু’ব্যাপারেই প্রচুর জনতার কপাল-করজোড় কাছাকাছি? তারপর দেবীস্তোত্রের মানে যদিও বা পরিষ্কার হল, যে নাদ প্রতিদিন অকাল মহালয়া, তার অন্তঃসার বুঝতে পারি না কেন?
ফ্যানন-এর ‘রেচেড অফ দ্য আর্থ’-এর ভূমিকায় সার্ত লিখেছিলেন, দখলদার দেশগুলো উপনিবেশের কিছু নেটিভকে বেছে নিয়ে নিজেদের কায়দায় ‘শিক্ষিত’ করে তোলে। সভ্যতাও তো অসংখ্য অপরিজ্ঞাত ধ্বনির মধ্যে একগুচ্ছকে আলাদা করে তাদের গায়ে অর্থের জামা পরিয়ে নাম দিয়েছে ‘ভাষা’। বাকিরা বেবাক বোবার বস্তিতে পড়ে থাকল, গৌণপ্রকাশের সেলোটেপ ঠোঁটে আটকানো...।
অথচ, ভেবে দ্যাখো, স্নানঘরের জলই কতরকম কথা বলে! যদি তুমি শান্ত হতে পারো, বালতি ভর্তি হওয়ার জল, মগ নামের জলদস্যু থেকে মাথায় ঢালা জল, শাওয়ারের প্রেমিক জলগুচ্ছ, এমনকি নাইটক্লাবের বাউন্সারের মতো ফ্ল্যাশটানা জলও --- মেঝের দেয়ালে প্রত্যেকের আলাদা গল্পের জলপনা!
সেইরকম, দার্জিলিং মেল-এর ধ্বনিলিখিত কবিতা আমি পড়ার চেষ্টা করি আরও একবার। শরীরে লাগা ঝাঁকুনি থেকে খুঁটে তুলে তার রাগসংগীতের মতো সামান্য স্পষ্ট গোঙানি, কিছু জোরালো আবেদন (যা ভাষা-আম্পায়ার তখুনি নাকচ করে দেবে) রাত-পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিই।
দেখে নিও গাছের মর্মর, হাওয়ার শনশন, আর দূরপাল্লার রাতের বুকে প্রাণ এনে দেওয়া ছুটন্ত শব্দরোল --- তোমাদের অথর্ববেদ, তোমাদের গীতবিতান একদিন ঠিক আবিষ্কার করব আমি, এই ভেবে নিজের অপেক্ষায় নিজেই জেগে থাকবো বলে বিছানার পাশের আলো জ্বালাতে হাত বাড়ালাম।
দুই
সূর্য ওঠার রাস্তাটা এমন, যে কেউ দেখলে বুঝবে শুধু সকালই হাঁটে সেখানে। সোজা চলে যান, গুম্ফা পড়ছে, তারপাশ দিয়ে সিঁড়ি... লোকে আরামসে বলে দেয়। কিন্তু এত শিশিরফল দুপায়ে থেঁতো করে, এত ঘাসের ক’ড়ে আঙুল ভেস্তে দিয়ে যেখানে গুম্ফা-কিশোরের কৌতুকমাখা চোখ লেগে আছে, আমি কীভাবে পৌঁছোতাম, যদি মিশি না থাকতো সঙ্গে?
মিশির সাদা অঙ্গ, মিশির বড় লোম, মিশির ভদ্রতা দেখলে কৃতজ্ঞতাক লেগে যাবে (দুটো শব্দ মিশিয়ে বললাম)। গুরুংলজ থেকে আমি বেরনোমাত্র সে এই ডানপায়ের গোড়ালি একবার শুঁকে নিয়ে আমার গাইড ও ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে নিজেকে স্থায়ি নিয়োগপত্র দিয়ে দিয়েছে।
যাহ্‌, পরের কথা আগে ফাঁস হয়ে গেল! আমি যে এখনও পৌঁছোইনি তিনচুলেতে! আজকাল যদি বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, সে এমনকি হাতের কাছে আজাদ উত্তরবঙ্গ হলেও, মানচিত্র লাগে, পিঠব্যাগে হাজার টুকিটাকি, ইন্টারনেটে ঝুঁকে পড়তে হয় দাবাখেলার চালচক্কর মাথায় নিয়ে। অনেকক্ষণ আগে ডাঙায় তোলা রূপচাঁদা মাছের মতো মন মরে যায় শুরুতেই। তারপরেও কত শেকলছেঁড়ার গান --- পোষা বেড়াল, অর্ধেক অ-শেষ করা বই, আদরের মুখ। নিষ্ঠুরতা, যে বাঘনখ ত্যাগ করতে অনেক সাধনাদিন গেছে, আজ আবার হাতে তুলে নিতে গিয়ে দেখি ভারি হতে হতে হাজার সিসি সিলিন্ডার বুক তা আর বইতে পারছে না।
পুরনো ফোটোগ্রাফের মধ্যে যেমন আর ফেরা যায় না, পুরনো অভ্যেসেও।
হয়তো এইসব পিছুটানই জোড়বাংলা থেকে আর কোনও গাড়ি পাঠাচ্ছিল না তাকদা-র দিকে। ‘আমি চলে এনু বলে...’ গাইতে গাইতে নড়বড়ে কোমর-সেতুতে ভারি রুকস্যাক চাপানো এই বিস্ট অফ বার্ডেন পায়চারিময় অপেক্ষা করতে থাকে। তখন চোখে পড়ে শেষ অক্টোবরে মুখচোরা সকালের মান্যগণ্য রোদ্দুরে পিঠ পেতে ক’টা মানুষ রাস্তার পাশে জুয়ো খেলতে বসেছে। নাম পারস, তিব্বতিদের হাত ধরে দার্জিলিং ভূখণ্ডে নেমেছে এই স্বর্গীয় আনন্দ। পারসের উপাদান দুটো ছক্কা, কিছু কড়ি, কয়েকটা ছোট কাঠি হলুদ আর সাদা রঙের। কানাতওলা বাটি কিম্বা ছোট্ট টুপি-পাত্রে ছক্কা নাড়িয়ে বাটি উপুড় দেওয়া হলে দুই ছক্কার ক’ফোঁটা চিৎ হল সেইমতো কড়ি গুনে ভাগ করে কাঠি সরানো হবে। এভাবে খেলার শেষে যার সব কাঠি ‘উঠে’ গেল, লুডো মনে করুন, তার জিত। বাকিরা নিজেদের রোজগার করা কাঠি-সংখ্যার সঙ্গে তফাত বিচার করে পয়সা দেবে, যেভাবে আমরা ফিশ খেলে থাকি।
পেছনের পৃথিবীর ব্যবসায়ে ক্ষতি, হওয়া কাজ না হওয়া, প্রেমে আঘাত এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাইরের লোক-এর ইতিহাস অস্বীকার করে পাশাপাশি পাতা দুটো বোর্ডে জনাদশেক উৎফুল্ল খুশমেজাজ হয়ে আছে, পনেরো বছরের কিশোরি যেভাবে বিনা অকারণে হেসে গড়িয়ে যায়, তেমনি নিরাশ্রয় উচ্ছ্বাস তাদের ভেতরে। যোগাসন ছাড়াই কত গ্রন্থি-নিঃসরণ হচ্ছে শরীরে, প্রৌঢ়ের যুবক-মুখে সেই গবেষণা! নদীর ঘেঁটি ধরে তার সরণি ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো মহাভারতের ঘটনাস্রোত যে একাহাতে পালটে দিয়েছিল, সেই জুয়োখেলার সুখ-সম্ভাবনা নিয়ে আমরা সিরিয়াসলি ভাবলামই না কোনওদিন। সংক্রামক জীবানুর মতো তাকে কাচের বোয়ামে পুরে দূর থেকে ভয়ে-লোভে তাকিয়ে থাকলাম শুধু। কেননা, যৌনতা আর নেশা করা নিয়ে রাষ্ট্রের ভয় নাগরিকের মনে জোর করে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তিন
জোড়বাংলা থেকে তিনচুলে যাওয়ার শেয়ার-জিপে বসে দেখি পাহাড়ি রাস্তা হঠাৎ মোড় ঘুরে এক্ষুনি সামনে শূন্যতার পর্যাপ্ত ঘুঙুর দেখিয়ে দিচ্ছে, তো পরের পলকে পাহাড়ের সার সার মাদলশ্রেণী। নিয়ম মানার কালো চাদর গা থেকে সরিয়ে একদিন সভ্যতাও সেলিব্রেশানের অন্য নাম হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞান নেশাড়ুকে সারিয়ে তুলে নিরানন্দ সুস্থ জীবনের শপথ নেওয়াবে না, বরং আসক্তির জন্যে সবল করে গড়ে দেবে শরীর। অথবা, অতিখরুচের পিঠে ভরসার হাত রাখবে অর্থনীতির মূল সূত্রগুলো।
কিন্তু আমাকে এত ভালো ভালো কথা ভাবতে দিতে জনগনের বয়েই গেছে। জিপে পাশের ভদ্রলোক তার বন্ধুর পেছনে বেশ শৈল্পিকভাবে লেগে গেলেন:
দিল দুঙ্গা এককো
মেরা দিল হ্যায় নেক
ইয়ে নহি কোঈ কেক
কে টুকড়া টুকড়া বাঁটু অনেককো
--- আমি চন্দন। আপনার নাম জানতে পারি?
এক মুহূর্ত থমকাতে দেখলাম না পাহাড়ি কবিকে।
--- রাকেশ রোশন!
এভাবে কত মুখ যে পেয়ে যাই অফিসে, রাস্তায়, ফেসবুকে, দোকানপাটে। আলাপ হয়ে মনে হয় আমার সব কথাগুলো, সমস্ত হাসি এদের কাছে জিম্মা রেখে ফিরিয়ে নিতে ভুলে গেছিলাম। এতদিন পরে তারা কেউ খাটো আঙুলের ফাঁকে খৈনির ডিব্বা, কেউ পাহাড়ের ঢালে কানপাশার মতো ঝুলতে থাকা ট্রি-টমেটো। মানুষকে সবচেয়ে ভালোবাসা যায় অর্ধেক অপরিচয়ের ব্যালকনি থেকেই। খুব চেনা উঠোনে একদিন চিতাবাঘসম্পন্ন জঙ্গলের গন্ধ উঠে আসে।
চার
চিলোনি কাঠের চিলেকোঠা, তার ঝুলবারান্দার চাবি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চা আনতে উধাও হল সুন্দর গুরুং। কেননা, ইহাই গুরুং গেস্ট হাউজ, তিনচুলেতে মাথা গোঁজার একমাত্র চুলো। এক চিলতে বাথরুম-নির্জনতা পেরিয়ে বারান্দা থেকে জরিপ করে নিই সূর্যোদয় কাঁধে নেওয়া পাহাড়, মেঘ-তিস্তা আর গীর্জার চুড়োর মতো পাইনশীর্ষ। ফিসফিসিয়ে সেই প্রকৃতিকে বলি, দাঁড়াও, হচ্ছে তোমার! যখন বর্ণনা করতে বসব --- ওই ঠোঁটের কুয়াশা, অন্তর্বাসের অন্ধকার সরিয়ে আরও ভেতরে যাবে আমার কলম–সর্বস্ব হাতের আঙুল, যেখানে ছোঁয়া পড়লে তুমি লজ্জায় ময়ূর হয়ে ওঠো, স্ট্যাচু ভেঙে ‘ফিক’ ক’রে দাও, আর আমি প্রমাণ পাই পৃথিবীর সব সৌন্দর্যেই স্তন আর ওষ্ঠচেতনা মিশে আছে।
কিন্তু তার আগে, অক্টোবরের গায়ে হেলান দেওয়া একটা অচেনা-কিন্তু-নিজের ঘর পেয়ে যাওয়াও কি তোমাকে কাছে পাওয়ার চেয়ে কম, বলো নিসর্গ? চেয়ারের মাথায় ভাঁজ করা সাদা তোয়ালে ছুঁই, ট্রে-র ওপর উপুড় কাচের গ্লাস বসাই সোজা করে, তারপর ড্রেসিং টেবলের সামনে দাঁড়ালাম। আর চমকে উঠে দেখি আমার অর্ধেক বয়েসি এক যুবক সেখানে --- শুভ্র ক’রে দাড়িকামানো পাতলা মুখ, কপাল-সাঁতরানো চুল তার, আর কন্ঠার হাড় উঠে আছে ফাঁকা রাস্তায় হোঁচট-সর্বস্ব নুড়িপাথর!
পাঁচ
শেষ-দুপুরের ফাঁকা ডাইনিং হলে ব’সে দেয়ালে গোছা গোছা ভুট্টা, শুকিয়ে লাল-এর ইন্টিরিয়ারের দিকে তাকিয়ে আছি, ঢুকলেন এসে এক পরিবার, তিনচুলের তিন চুড়োর মতো মা, বাবা, মেয়ে। সামনের টেবিলে আমার মুখোমুখি দুজনে, আর ভদ্রমহিলা --- হলুদ শালটাই শুধু দেখতে পাচ্ছি --- পেছন করে উপবিষ্ট।
যে কোনও বাঙালির অন্তর্তদন্তমূলক প্রতিবেদন তার প্রতিবেশীকে নিয়েই শুরু হয়:
--- কতদিন এসেছেন? একা? কেন! কবে নামছেন পাহাড় থেকে? এনজেপি থেকে হলদিবাড়ি এক্সপ্রেস ধরবেন? কেন? কলকাতায় থাকেন কোথায়?
প্রশ্ন এড়ানোর জন্যে সুন্দরের সঙ্গে গল্প জুড়তে হয়।
--- এখানে পেশক চা বাগানের মধ্যে গুম্বাদাঁড়ার ঠিক আগে একটা ভূতের ডেরা আছে, না?
সুন্দর অবাক এবং সন্দিগ্ধ।
--- আপনি কীভাবে জানলেন!
--- যেভাবেই জেনে থাকি, আছে কিনা? ওখানে পনেরো-ষোলো বছরের একটা ছেলে গলায় দড়ি দিয়েছিল। তারপর থেকে ওই পথে তার অশরীরি আত্মা ঘুরে বেড়ায়।
এবার প্রতিবাদ করে সুন্দর।
--- বকওয়াস, কিস্যু নেই। আমি আর আমার এক বন্ধু রাত সাড়ে এগারোটায় গুম্বাদাঁড়া দিয়ে পাস করেছি এই সেদিন।
--- তুমি ভূতে বিশ্বাস করো?
--- নাহ্‌।
--- তাহলে দেখতে পাবে আশা করলে কী করে! মানুষের প্রেস্টিজ আছে, ওদের নেই? প্রেতাত্মার অস্তিত্বেই ভরসা রাখে না যে, তার সামনে হ্যাংলার মতো এসে হাজিরা দেবে? উহুঁ! এই একটা ব্যাপারে ভূত-ভগবানে খুব মিল!
--- আপনি লেখক, না?
চমকে তাকিয়ে দেখি সেই হলুদ শাল, ভেতরে অতল নীল বুটিদাগ, এতক্ষণে মুখ ফিরিয়েছে আমার ওপর। বাহ্‌। বেশ চোখজুড়নো চোখদুটো তো! সেখানে বিস্মিত আনন্দ আর আর নিচে টিপে রাখা ঠোঁটের অন্দরে এক পশলা বুদ্ধিমতী হাসি।
--- না না, ওসব কিছু নয়।
--- বললেই হবে? একা একা কেউ এতদূর বেড়াতে আসে! লিখবেন বলেই তো এসেছেন। তারপর এই যে রুম-বয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন, আমি যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। আচ্ছা, আপনি কি শুধু গল্প লেখেন? নাকি কবিতাও!
এই মেয়েটা নিশ্চয়ই বাংলার নারীসমাজের শেষ প্রতিনিধি, লেখক শব্দটা শুনলে যার মনে করুণার বদলে গায়ের চাদরে নতুন কলকা ফুটে ওঠে? ভুরুতে মোচড় না দিয়ে এমন গনগনে বিরক্ত বরের সামনেই কথা বলতে সাহস হয়! দু’গালে বাকি খাওয়া সেরে উঠে পড়ি। বেসিনের দিকে যেতে যেতে বুঝি, সাবেক নারীর চুলের কাঁটার মতো তার দুই-দৃষ্টি আমার পিঠে বিঁধে আছে।

হায় রে মেয়ে, সারা জীবন সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে তোমরা কোথায় থাকো, আর আমরা কোথায়! যখন হাতভর্তি কাশফুল নিয়ে মাঠের রোদ্দুরে ছুটে বেড়াও, আমরা কুন্ঠিত শীতের সন্ধে উজিয়ে ঘর খুঁজতে থাকি। তার বহুযুগ পরে বিভ্রান্ত তুমি-র সঙ্গে থ্যাঁতা রক্তমুখ আমি-র দেখা, পুঞ্জপাইন, ফুলকপি-মেঘে ছাওয়া সূর্যাস্তের টেবিলে। তোমার ছোট হয়ে আসা খোঁপা, রোগা কাঁধ আর সামান্য শ্বাসকষ্টের মাটি খুঁড়ে কিশোরীমুখ পুনরুদ্ধারে আমার তো অসুবিধে হয় না। কিন্তু তুমি কী করে চিনলে এই কাঙাল ব্যঞ্জনবর্ণ ক’টা? নাকি সেই কবে থেকে পাহাড়ের চিলেকোঠায় আয়না হয়ে আছো, যেখানে একটু আগে ছোটবয়েসি নিজেকে দেখে এলাম...।

ছয়
ওয়েবসাইট বলছিল, ড্রাইভার অমিত ভুটিয়া বলেছে, স্থানীয় সড়ক যোজনাও একই সুর ভাঁজতে থাকে --- হ্যাঁ, চিতা আছে। তবে সন্ধের আগে নয়, দোকানপাটের এদিকটায় নয়। তিনচুলেতে আছে, লামাহাটায় থাকার কথা, চাতকপুরে তো অত্যন্ত ভীষণরকম! তাছাড়া, লেপচাজগতের বন-বিভাগের বাংলোয় দারোয়ান তালা লাগিয়ে দেয় দিনের আলো নিভতেই। লোলেগাঁওয়ের বস্তি এলাকায় যারা শাল বেচতে যাচ্ছে, সেইসব মুর্শিদাবাদী কাশ্মিরীদের জিগেস করলে আখোঁ দেখা হাল পাওয়া যাবে!
আজ অমিত আমাকে সাইট সিয়িংয়ের নামে স্বর্গ যদি কোথাও থাকে-তে নিয়ে গিয়েছিল! লামাহাটা। জিওফ বয়কটের দীর্ঘ টেস্ট ইনিংসের মতো না-হেল না-দোল ঝাউবন তার প্রচ্ছদ। সেই এক-এক ঝাউগাছের কোটিপত্রের প্রত্যেকটা যে কতগুলো করে সবুজ স্ফটিক বেঁধে বেঁধে গড়ানো, বুঝতে পারলে তাদের এই অপরিসীম ভেলভেট-শরীর, তাদের ঝাঁকড়া দোলন, তাদের চক্ষুশিশির ধরে রাখার ক্ষমতা --- সব কুয়াশার মতো স্পষ্ট হয়ে যেত। আমি আগেও বলেছি এবং বলার বহু ভূতপূর্বে আমি বলে এসেছি যে কুয়াশা পাইনবাগিচায় কলোনি করে থাকে। আর, তাদের শিবির হয়তো পাইনবাগের জন্মের আগে থেকে পাইনে শুভসূচনা। কাজেই জাগ্রত হয়ে উত্থিত, ও উত্থিত হয়ে আমি সেই অতি-পরিচ্ছন্ন অরণ্যে ঢুকে যাই। ফার্নকুঞ্জ কিছু কিছু দূরে, লোকটিমাত্র নেই, ওমনি হঠাৎ চিতাবাঘের মনগড়া হাজিরা হাজির হয় মনের মধ্যে। দাঁত দিয়ে আখ ভাঙার মতো আধা-ওলটানো গাছ, লক্ষ্ণৌ শালের আদলে শ্যাওলা, গুঁড়ির গায়ে কোথাও যোনিকোটর, এমনকি জলধারাবেতের মার খেয়ে বিনয়ী হয়ে আসা পাথরের হাসিমুখ --- সবকিছুর ছবি তুলতে থাকি সেই চিতাকে একটু অফ ফোকাসে ধরে রেখে।
পাথর-বসানো সিঁড়ি বাইতে বাইতে বসে যাই কাঠ কেটে বানানো মাচায়। পাশে মাটিশিলাগুল্মগাছে ঠাসা পাহাড়দেয়াল। তার গায়ে আস্তে হাত। নাকে সুড়সুড়ি লাগানো ঘাস পর্যন্ত মুখ নামিয়ে নিয়ে চুমু রাখি নোনতা, কীট-চলা মাটির সজলে। বলি, কখনও খ’সে প’ড়ো না, বন্ধুরা। কোনও বর্ষারাতে, কস্মিন গ্রামের পায়ের নিচে থেকে, কোনও ট্যুরিস্ট জিপের পিঠের ওপর। ধ আর দন্ত্য স কিছুতে পাশাপাশি না আসতে পারে দেখা দরকার; উচ্চতা আঁকড়ে থাকো, কুয়াশা ও রোদ --- তোমার দুই জমজ সন্তানের রোজ জন্ম হোক। তখন মনে পড়ল, আমার বেঁচে ওঠার বহু আগে মরে যাওয়া ঠাকুমার কথা। খুলনা, সেনহাটি গ্রামের বাড়িতে প্রতি সকালে গোয়াল থেকে গরু বেরিয়ে মাঠে চরতে যাওয়ার সময়ে তার কানে কানে বলে দিতেন, দূরে যেও না, মুখ দিও না কারও ক্ষেতে, গলার দড়ি ছিঁড়ো না, সন্ধের আগে ঘরে ফিরে এসো!
আমি নাড়িতে বয়ে বেড়াচ্ছি আমার পূর্বনারীকে...।
সাত
আজ সমস্ত সকাল বেতের চেয়ারের ভেতরে ভ্রমণে যাব ভেবে গোলাপি কুশনে অকাতরে, হাজার-হাজার ব’সে থাকলাম। আমি স্তব্ধ ব’লে দিনও নিঃশ্বাস বন্ধ করে।
মেঘের তেষ্টায় ওথলানো আর কুয়াশার দূরবীনে চেকনাই বারান্দাটা। যদি বিস্কুটের একটা চকখড়িদাগ টানা যায় রাস্তার চৌমাথা থেকে লজের বাগান পর্যন্ত, তার ওপর দিয়ে হেঁটে মিশিও এই ব্যালকনিতে অসংখ্যভাবে বসে গেছে।
আস্তে আস্তে ভিজে রোদ, গাছের অতিসবুজ ডাক, পাহাড়ের কুহক মুছে যায়। দেখি আশআশের খাদ থেকে দুধের মাখনের মতো ভেসে উঠছে নিঝুম। সে দেখতে পরিচ্ছন্ন আর খুব ভালো স্বাস্থ্যের। আচ্ছা, আমার মতো একটু আলসে কি?
নিঝুম যে এত গভীর মনের, দারুন বাংলা কবিতা বুঝিয়াল, জীবন নিয়ে কোনও প্রশ্নের উত্তর অচেনা রাখেনি, অথবা ঝাঁকুনি ছাড়াই পারে পৃথিবী থেকে পৃথিবীকে সরিয়ে আনতে --- এইসব অনবদ্য সত্যের ভেতরে আমি ডুবে যাচ্ছিলাম। হ্যাঁ, সময়ের এখানে-ওখানে এক-আধটা পাখি ডাকছিল তো! বাসন-সরানো হাতের গুনগুনও, কিন্তু তারা নিঃশব্দের বর্ষাতি ধ’রে গড়ানো দুএকটা মাত্র হেম-সেলাই।
সারা জীবন শুধু মনে মনে যেসব ইচ্ছে ভেবে গেছি, আজ এই শুনশানে তাদের অনুচ্চারণ স্পষ্ট কানে বাজতে লাগল। তারপর, কেমন ব্যথার আজান পেয়ে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে দেখি, হা জীবন, সেই আকাঙ্খারা অবিকল গায়ে উলকি হয়ে আঁকা! নিঝুম যদি গলা শুনিয়ে থাকে, তাহলে কে লিখতে পারে দেহখাতাতে ভেবে আমি শীতকে সন্দেহ করি, যেহেতু তার গায়ে কাঁচা কাঠের হলুদ গন্ধ, গালে রোদ্দুরের কোল্ড ক্রিম। যেহেতু শীতেই টাটকা সবজির মতো কবেকার পচে যাওয়া ইচ্ছেসকল সেরে ওঠা সম্ভব। আমি তাকে দোষী করব বলে ঠোঁট খুলতেই মুখের মধ্যে একটা পিপারমেন্ট লজেন্স ছুঁড়ে দিয়ে শীত দৌড়ে পালাল আর তৎক্ষণাত ‘ঘেউ’ দিয়ে পেছন পেছন ছুটল মিশিও।
আট
আসলে, সিজন শুরু। বোলেরো, সুমো, অলটো ক’রে ভারি স্পোর্টস শু-র অশ্বারোহী বাহিনী সকালে দুপুরে সন্ধেয় ঝাঁকে ঝাঁকে এসে জমছে পাহাড়ের পাকস্থলি, বুক, কন্ঠনা্লীতে। তা থেকে কমেন্ডোর মতো লাইট ক্যামেরা-গান উঁচিয়ে লাফিয়ে রাস্তায় পড়ছে ট্যুরিস্ট। লটবহর দেখলে উপনিবেশ আগ্রাসনের গল্পই মনে পড়ে। কীভাবে ফিরবো শান্ত নির্জন আমার কলকাতা শহরে!
তিন কিলোমিটার দূরে তাকদা পর্যন্ত যেতে পারলে অনেকটা নিশ্চিন্ত। সেখানে থেকে শেয়ারের গাড়িতে রাস্তা ভেঙে ভেঙে সমতলে পৌঁছনো যাবে। অমিত ইয়াররিংয়ের মতো যত্নে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলে: কাল বিকেলে তো আমরা কেভ পয়েন্ট দেখে এলাম পেশক চা বাগানের মধ্যে উঁচু টিলার মাথায় চেপে? সন্ধেবেলা গ্রামের লোক ওখানেই চিতা দেখেছে, দুটো বাচ্চা সমেত বাগান থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে খাইয়ের মধ্যে ঢুকে গেল।
শুনতে শুনতে মনে হয়, আমাদের ভয় চিতাকে, না চিতায়? আতঙ্ক মানে কি! হিংস্র কামড়, অথবা কাঠকুটোর তেজে অন্তিম ঝলসে যাওয়া? এ-জীবনে মৃত্যুর সমোচ্চারিত শব্দের বোধহয় শেষ নেই...!
যখন অরক্ষিত দুপুরবেলা লামাহাটা পাহাড়ের তরল মস্তিষ্কের মতো ছোট্ট লেকের সামনে বসে ছিলাম, ভুখা চিতাবাঘ ওই পাহাড়েই হয়তো আরেক গুল্মের নড়ে ওঠাকে বুনো খরগোশ ভেবে ধোঁকা খেয়েছে।
হলুদ-নীল শাল মনে পড়ল। কাল রাতে একটু দেরিতে ডাইনিংরুমে ঢুকে দেখি, ওদের টেবিলেই খালি চতুর্থ চেয়ারে আমার বসার ব্যবস্থা, নকশাদার স্টোলের ঠিক মুখোমুখি। অবাক লাগল, চাদরের খালি জমিতে নীল তারার ভেতরে ভেতরে আজ নতুন ফুটে উঠেছে লতানে ছায়াপথ, জাফরান রঙের! কিছুক্ষণ উসখুস, তারপর সে বলে: জানেন, আমরাও আজ সাইটসিয়িং করে ফিরছি। ড্রাইভারকে জিগেস করছিলাম, সেই মৃত আত্মার কথা...ছেলেটা কেন মারা গেল? ব’লে খুব এক অন্যরকম চোখে তাকাল সেই মেয়ে।
মনে হয়, সারা আয়ুকাল সমান্তরাল দুটো দেয়াল দিয়ে তৈরি। প্রথম পাঁচিলের একপাশ দিয়ে হাঁটি আমি, অন্যপিঠে পায়চারি আমার জীবন। ঠিক ওইরকম, দ্বিতীয় দেয়ালের একধার দিয়েও আমি ভ্রমণে, অন্যপাশে আমার মৃত্যু বয়ে যায়। আড়াল ভেঙে গিয়ে একদিন প্রত্যেকে হাতে কলমে আসল মৃত্যুকে তো পাই!
তাহলে সব মরীচিকা ডিঙিয়ে প্রকৃত জীবনও একবার জোটার কথা আমাদের, অন্তত একবার...।
নিশ্চয়ই জুটবে। অর্ধেক শিউলি-তোরণের মতো নুয়ে থাকা আমার মনের শীর্ষ মাথা উঁচু করতে করতে বলে।

আমি রাবাঙালি হবো

আমি রাবাঙালি হবো
এক
'বেরিয়ে পড়া'র স্বপক্ষে হাততালি সব সময়ই সীমাহীন, কিন্তু কখন তার অদায়েঁ আমাদের ঘায়েল করে দেবে? যখন সে সামনে বসিয়েছে ‘হঠাৎ ক’রে’। আবার, একটা সফরের মধ্যে থাকাকালীন তুমি আবার বেরিয়ে পড়তে সক্ষম। তখন, বাইরের বাইরে থেকে বাইরের ভেতরে যাওয়া। তেমনও ঘুরতে হয় --- টিভির রিমোট আর রুম সার্ভিস মিলে ভ্রমণ জেলখানা হয়ে গেলে। যেভাবে প্রেমে দাম্পত্যবিষ মেশে।
জীবনে আর কী কী লাগে জানি না, কিন্তু একটা ড্রাইভার! যার গাড়ির ট্যাঙ্কি খালি নয়, পেনড্রাইভে ভালো কালেকশান, কম কথা আর কোনওভাবেই তোমার অভিসারে কাঁচি চালাতে চায় না। বরং সে নিজেই এক প্যানোরামা। রাস্তার-ধার রেস্তোরাঁয় খেতে বসে ছুরি দিয়ে আলগা ক’রে পাহাড়সন্ধি --- চামচে ক’রে তার ফাঁক থেকে লেটুসপাতার মতো উদ্ধার করে আনছে হারানো পাইনবন। স্টিয়ারিং-সম্পদে ধনী সেই সুন্দর গুরুংয়ের স্লোগানই এইরকমঃ চলো ২৬ কিলোমিটার কি চলো ৪২ কিলোমিটার। ভাবতে ইচ্ছে করে, নেতাজি তার দিল্লি চলো ডাকের সঙ্গে আগাম দূরত্ব মেপে দিলে ব্যাপারটা আরও প্রেরণাদায়ক হতো কিনা। কেননা, সুন্দরও জানে, ওমুক লেক, তমুক মনাস্ট্রি আসলে বাহানা, স্টার হচ্ছে রাস্তার পাশের এই অনুসূচিত ফুলগাছ যার ‘নাম কী নাম কী’ করতে করতে শুকিয়ে উঠবে ক্যামেরার কন্ঠনালী! অথবা সিম্পলি সুবাতাস; ফুল নয়, গাছের গায়ের শার্টের গন্ধ। ভিজে ঠান্ডা একটা আহ্‌ থেকে অপরিসীম আহা পর্যন্ত মন ভালো হয়ে যাওয়া।
গ্যাংটকে দুদিন বসে থেকেও ইয়ুমথাং ওঠার ধস-বরফমুক্ত রাস্তা পাইনি। তাই ভ্রমণঘুড়ি ঘুরিয়ে ঢুকে পড়েছি অন্য আকাশে, পশ্চিম সিকিমের রাবাংলায়। ইতিমধ্যে ছুটির দিনগুলো প্রায় খেয়ে গেছে বলে ঠিক করলাম দিনরাতে বড়জোর দশ ঘন্টা হোটেলের মুখ দেখব, বাকি যা হবে --- পথিমধ্যে, যা হবে --- অন হুইলস্‌।
কিন্তু তুমি শুধু তীরে বসে মধুর হেসে চাকরি-বাকরির গল্পই শুনবে, হারিকেনের জং-পড়া আলোয়, ছেঁড়া বেডকাভারে আমার মাধ্যমিক পাশ জানবে না?
চলো, পাহাড়ে ওঠার রাস্তাটা একবার এঁকে দিই তোমাকে।
দুই
--- তিস্তা কে হয়, শুনি?
--- আপনার যা, আমারও তাই!
--- ইশ, আমি হাভাতে নাকি ওইরকম! চোখ তো সরাতেই পারছিলে না দেখলাম। গায়ে-ফায়ে হাত দাওনি তো?
--- ছিঃ! এটা ভাবতে পারলেন! এতটুকু ফেথ নেই আপনার? আমার পরে না হোক, মেয়েটার ওপর!
ধুলোমাখা চোখে সে তাকিয়ে থাকে। প্রচুর সাদা দেখেছে, কাজেই এখানে কবি নাম ধারণ করে এসে ‘ওকে নিয়ে লিখেছি’ বলেই তিস্তার রিভার-বেডে তাঁবু খাটিয়ে শুয়ে পড়া বাস্তুঘুঘু কিছু কম চেনে না।
তিস্তারা পাহাড়ে থাকত। তখন ওই বয়েসে ওই জ্ঞানে আমাদের পাহাড় মানেই দার্জিলিং। তো, দার্জিলিংয়ের মেয়ে সব সময় উল্টেই রাখত শুকনো ঠোঁটদুটো: ধুস, এখানে ভালো টপ হ্যাট পাওয়া যায় না; ভাল কুকিস, গুড কোয়ালিটি জ্যাম পাওয়া যায় না; লেদার জ্যাকেটস তো নেইই! ধুস, আমি দুবছর পরে ফিরে যাবো, কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি হবো গিয়ে।
কনভেন্ট মানে বড়লোকদের সেই বিদ্যালয় যেখানে টমাসকে থমাস বলা হয়। তিস্তা বলত।
তার অনেক পরে পাহাড়ে এসে বুঝেছি, কেন মেয়েটা জন্ম থেকেই নারী। প্রাইমারি স্কুলে দেখতাম, তখন আমরা ক্লাস থ্রি-ফোর, একই বেঞ্চে...কিরে, সরে বসতে পারছিস না?...মানে, তিস্তা। পার্বতী কি নীলিমার সঙ্গে মুখচাপা ফিসফিস করতে করতে হঠাৎ উলটো দিকে ঘুরে, এ-মা মেয়েদের কথা শোনে, লজ্জা করে না!...মানে তিস্তা-ই।
যে অপরাধ আমি করেছি, তার বিষয়ে কে না জানে। কিন্তু যে অন্যায় আমার ভেতরে নেই, অথচ ভবিষ্যতে এসে পড়তে পারে, তার জন্যে সেই ছোট্ট বয়েসে আগাম শাস্তি দিয়ে রাখতো সে!
তো, এবারও প্রত্যেক ছোটবেলার মতো আমি দেখার আগে আমাকে দেখে ফেলেছে তিস্তা। ওমনি প্যাঁক প্যাঁক করে উটপেনসিল-রং হংসী দুই পাহাড়ের পায়ের পাতার মধ্যে প্রণামের মতো ঢুকে পড়ল। পাগলা হাতির আদল সেই পাহাড়শ্রেণীর গুলি-বেঁধা একখণ্ড শরীরই ছিটকে এসে পড়েছে মাঝ-রাস্তায়। কখন ধস সরবে, সার দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে।
আমার সঙ্গে সংলাপ যার ---এই বৃদ্ধও এক পুরনো ভাঙন, উলটো দিক থেকে গড়িয়ে খাদের পাশে থেমে থাকা। তার গায়ে ফার্ন, পাখির পালক আর বৃষ্টির দাগে আলতো হাত রেখে বলি শুনুন, মিথ্যে বলব না, তিস্তার বুকের কাছে নেমে এসেছিলাম একবার, রংপোতে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, দুপাশে পেস্তার কেয়ারি করা কেকের টুকরো। তারপর তিস্তার ডানে আর আমার বাঁদিকে যেখানে সিকিম মনিপাল ইন্সটিটিউট, জঙ্গলের গন্ধ শুরু হল। সবার চোখ এড়িয়ে অরণ্যের ব্রীড়ার মধ্যে প্রবেশ করলাম দুজনে...। সে গল্প নামার সময়ে বলে যাব, আগে রাস্তা খালি করুন প্লিজ, সেরে আসি টোটোপনা।

তিন
বহুদিন আগে একবার পাহাড়ে যাব, হলদিবাড়ি এক্সপ্রেস দুপুরে ফরাক্কা পেরোচ্ছে দেখে দরজার কাছে এলাম। একটা অবাঙালি ছেলে পাদানিতে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে নিচে তাকিয়ে আছে। তার পায়ের নিচে সেতু, সেতুর নিচে বাতাসের দীর্ঘ এক জমজমা, বাতাসের নিম্নে বুনিয়াদি জল। হঠাৎ পেছনে মুখ ঘুরিয়ে সে মুগ্ধ চোখে বলে উঠেছে, পানি বহুত হরকত কর রহী হ্যায়। গা শিউরে উঠল আমার। ওমনি চোখের সামনে স্ক্রিন পালটে গিয়ে এসে বসেছেন বীণাবাদিনী। তার মিল্কমেড শাড়ি, পাড় তানপুরো রঙের। একটু জোরে বইছে বাতাস, তাই আওচার সেরে বুকের আঁচল ঠিক করে নিয়ে তিনি রাগের অন্তরা ভরতে চললেন।
গত পরশুর শেষ দুপুরে যখন গ্যাংটক উঠব বলে বেরিয়েছিলাম, তিস্তার কোলে চোখ পড়তেই বুঝেছি সে এক লয়দার বহলওয়ার মধ্যে আছে। সূর্যের আলোয় চিকচিকিয়ে উঠছে ফেনার এক একটা ফ্রেজ; যেখানে নিচু উপত্যকার দিকে গেছে পাহাড়, সেখানে তিস্তার ঘূর্ণিতে লরজদার ভারি তান ছুটছে। নিসারে নি সারে সা নি --- এই স্বরগুচ্ছে পরিষ্কার বেহাগ। আরও একটু ওপরে উঠতেই স্রোত গান্ধারে ন্যাস রেখে রেখাবে কণ্‌ ছোঁয়াবে। আহ্‌, আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম...।
চার
কবে থেকে ভেবেছি, এই কাট্‌টুসকে একবার দেখে নেব। যেখানে ফুলগাছ নেই, সেখানে যদি একতোড়া মেয়ে খোঁপায় ফুল গুঁজে সার সার দাঁড়িয়ে যায়, সেও তো বিকল্প সৃজন! ভেবেছিলাম, বাতাসে প্রচুর পরাগ-সংখ্যক আলো এনে দেবার জন্যে আমার হাত দুশো ফুট উঁচু করে এদের মাথায় সূর্যের স্তব পড়ে দেব একবার।
তারপর যেহেতু পাহাড়ের রাস্তাগুলো স্প্যানিশ গিটারের তার বেঁকিয়ে তৈরি, আমি উঠতে-ঘুরতে একবার দেখি বিশেষ কোনও অধ্যায়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে আলোছায়ার বাঘছোপ। আলোর অন্তর্নিহিত হলুদ, ফুলের আভাময়ী হলুদ, তার সঙ্গে কুয়াশার ফরম্যাল ধূষর আর ছায়ার শক্তিশালী বিবর্ণতা মিশে বাগান তৈরি হয়েছে। ধুলোর চেয়ে পথে কিলাউরি-র বালুতট বেশি...তখন কেউ বলে এটা কাট্‌টুসের বন। নিজের অনুভবের বাইরে আছে যে দৃশ্য, তাকে অবলোকন এক জিনিস, আর আজ দৃশ্যের ভেতরে বসে থেকে দেখছি তাকে!
মনে পড়ল, যখন তোমাকে বুকে ধরে যত্ন করেছি কোনও দুপুর বারোটার গোধূলিতে --- মাথার সিঁথি থেকে পায়ের কড়ে আঙুল পর্যন্ত যে আদরপ্রপাত পৃথিবীর দীর্ঘতম, তার গিঁট খুলে দিতে গিয়ে সেই মুহূর্তে হঠাৎ মনে হতো, তুমি হয়তো কিছু পরে একটা হলুদ-নীল শাড়ি পরে আমারই সঙ্গে রাস্তায় বেরোবে। এই তুমিকে আমি কি আর খুঁজে পাবো? সেই শরীরে? এই পোষাকহীন পরিচ্ছদ, কোমরের ডৌল, ঠোঁটের বিভা আর স্তনের সুউচ্চ নরমতাও যেন কীভাবে বদলে যাবে সেই সামাজিক রোদ্দুরের ভেতর, অচেনা হয়ে যাবে।
এখনও কতোটা সৌন্দর্য আঁকা আছে বাতাস-বিমানে, কুয়াশা-প্যাসেঞ্জারে, উদ্ভিদ-অবরোধে --- দেখার তেষ্টায় ছুটে আসি তোমার কাছে টাকা অগ্রাহ্য, শরীর অগ্রাহ্য; কিন্তু ও ঝর্নাতল, হে উইপিং ফার্নেরা, আমি বুঝতে পেরেছি, যেভাবে শামুক ঘরের মেঝেয় হেঁটে গেলে পেছনে একটা ঠোঁটচাপা মায়াবি ভিজে রেখা পড়ে থাকে, তেমনি সৌন্দর্যের চলন শুরু হয়েছে আমার উঠোনের পেয়ারাপাতার ফ্রেমে বাঁধানো রোদ্দুর, আমার জানলার পাখিডাক থেকে। খুব নিকট-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে ধ্বংস হয়ে যাওয়া আমার প্রেম থেকেও। তোমাদের দেখতে না পেলে আমি যে কবেই অন্ধ হয়ে যাই!
পাঁচ
রাবাংলার বুদ্ধ পার্কের দিকে যে রাস্তার গতি, তার মাঝখানে সাদা বর্ডার --- পথের পৌষ্টিক নালি শুয়ে আছে।
এল তাশিডিং। সেখানে কোনও ডিং ডং স্কুলের ঘন্টা শুনিনি। দুকিলোমিটার চড়াই ভেঙে মনাস্ট্রি দেখা বারণ হল। কিন্তু তার আগে মিশে গেছে রঙ্গিত আর লোডংখোলা। রাজযোটক। পাহাড়ের সম্মতিতে, পাহাড়ের ব্যবস্থাপনায়, পাহাড় সেখানে তন্ত্রধারী। রঙ্গিতকে দেখা একটু চেনা চেনা লাগছিল। তারপর মনে পড়ল, ওহ্‌, বিরাট কোহলি। একই ধরণের জলের ছাঁট, হাঁটাচলার কায়দা, ঢেউগরম বুদবুদ!
তাশিডিংয়ের গায়ে একটু থেমে দাঁড়িয়েছিল বোলেরো। পঞ্চম ছুঁয়ে আবার কোমল ধা-য় উঠে আসে, আরিথং যার নাম। যার চেহারা চোখলজ্জার লাল পুষ্প, রডোডেনড্রন! তোমাকে দেখব বলে আমার সোনাজয়ী দৌড় ছিল, ভ্রমণসঙ্গীর এপাতা-ওপাতা ফর্দাফাঁই মুখস্থ ছিল, অথচ সেই সুউচ্চ উচ্চতায় তোমার পুরো মুখচ্ছবি আমি ক্যামেরায় ধরে নিলাম না, অর্ধেক রাখলাম তোমারই জন্যে। কেননা মনে হল নিঃঝুম লাল খুব বেশি ফোটেনি এখনও, সঙ্গীসাথীর ঢাক বাজছে না, সামনে প্যান্ডেল যদিও উঁচু তুষারমুকুটে, আর দূরে গুম্ফার মাথায় ইঁদুর-পতাকা।
তারপর ইয়কসামের টেরিটোরিয়াল বন শুরু হল হিংস্রতাহীন, কোনও ভালুকের লোম, কোনও হায়নার মাংসপেশি ছাড়াই। আর পথের বাঁক ফিরতে ফিরতে যখন কৃষ্ণসার হয়ে পড়েছি নিজেই, গাড়ি আমাকে খুলে দিল ফামরং জলপ্রপাতে। কাছে পৌঁছনোর সিঁড়ি আছে কিন্তু এই ঝোরা আমার মতো নয় তো, যার নিকটদর্শন মানেই বিকটদর্শন? গুছিগুছি আগাছার সন্তর্পণ মাড়িয়ে উঠতে থাকি, এত রঙিন প্রজাপতি ওড়ার স্কেচপেনরেখা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে।
অনেক উচ্চতা বেয়ে, ছবি তোলার অজুহাতে জিরোন খেয়ে, জিরোনের বদান্যতায় অর্কিড সমাহারে মুগ্ধতার দুচারটে গন্ধপুষ্প ছুঁড়ে দিয়ে যেখানে উঠে এলাম, সে এই লোমশ ক্ষিপ্র জলপ্রপাত দেখার ওয়াচটাওয়ার। কেননা গোটা জঙ্গল খুঁজে এই একটাই শ্বাপদ পেয়ে যাই আমি, জলের প্রত্যেক শ্বেতকণিকা আসলে যার ক্যানাইন টিথ। আর আশ্চর্য হই, ধুলোজমাট সেই দেয়ালহীন গোলঘরে পড়ে আছে কয়েকটা পোড়া কাঠের চ্যালা!
তার মানে কোনও জুটি এখানে রাত কাটিয়ে গেছে... কাঠের আগুনে চিতাবাঘ, পাইথন বা শীতই শুধু দূরে সরাতে চায়নি, দেখতে চেয়েছে নিজেদের আশ্লষের মুখ! তেমন একটা জায়গা বেছে নিয়েছে, যেটা পৃথিবীর বাইরে, মহাপ্রকৃতির। সময় আর সমাজের ফ্রেম ভেঙে দিয়ে এই সেই বেরিয়ে পড়া, পরিধি থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ভিতরকণিকায় শুভভ্রমণ।

ছয়
তখন খসখসে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সন্ধে শুরু তার মাত্র কয়েক গজ পরে। আমি জঙ্গলের হৃদয়ের সন্ধের কথা বলছি।
ড্রাইভার ভয় দেখাচ্ছে, ‘জানে-আনে মেঁ’ এক ঘন্টা লেগে যাবে।
আমি পুরুষাঙ্গের মতো প্রবেশ করি সেই কালো নির্জনতায়, শেষমুখে উদ্গীরণ --- বেনডেন্টসে রাজপ্রাসাদ --- দেখতে পাবো। এম ভি আন্দামান তিন দিন টানা সমুদ্রে ঢুকে আসার পর জলে যে তরঙ্গ পাওয়া যায়, একটা গুঁড়িশুঁড়ি রাস্তায় তেমনি থমথমে ওঠবস করতে করতে এগোচ্ছি। জলবিন্দুর জায়গায় শুকনো পাতার বাদামি ফোঁটা, সেই এক-দুই...ত্রিস্তর বিস্তারের ওপর পা চালাই। কিন্তু দুপাশের ঝুরি-নামানো, লতা-দোলানো অন্ধকার আলোর ধমনীকে শতকরা সাতানব্বই ভাগ বন্ধ করে বসে আছে, কাজেই আলোও অতি-সন্তর্পণ, সামান্য নড়াচড়ায় সে নিজেকে খুইয়ে না বসে!
গলিটাকে দু’পায়ের পক্ষে উচ্চারণ করা ক্রমাগত কঠিন হতে হতে চোখে পড়ল আবছায়ার ধার ঘেঁষে খয়েরি পোষাকের মাথায় টুপি পিঠে পাহাড়ি মোট মানুষটা একলা উলটো ঘুরে বসে আছে। তাকে রাস্তা জিগেস করতে যাবো, আরেহ্‌, সে এক অর্ধেক কেটে ফেলা গাছ, আপনা থেকে তৈরি ভাস্কর্য!
ঠিকই তো। গাছ না কাটলে মানুষ হয়?
তখন আমাকে নিয়ে ভাবনা শুরু হল জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ারও। যেমন শ্রাবণের ছুটির বিকেলে হঠাৎ চেয়ারটেবিল চায়ের কেটলি নড়ে উঠলে বয়স্ক মহিলা জিভের তীব্র উলু পড়তে থাকে, রাস্তার পাশে নীল বোর্ডে তারা অবিকল সাদা হরফের শাঁখ ফুটিয়ে রেখেছে: ভয় পেও না, আর মাত্র পাঁচশো মিটার!
গাছের নিরাপোষ সাদা কাণ্ডের পাশ দিয়ে রাস্তাটা এখুনি আমাকে উগরে দিল যে খনন চত্বরে, সেটা এক চোর্তেন। পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠেছে মূল প্রাসাদের দিকে, বাঁয়ে সরকারি দপ্তরের সংগ্রহশালায় মাটি খুঁড়ে পাওয়া ভাস্কর্য সাজানো। কিন্তু এখন সবাই বৃষ্টি-কুয়াশা-মেঘের ত্রিপিটক আক্রমণের মুখে। কাত হওয়া ছাতা দিয়ে জ্যাকেট, আর ভিজে জ্যাকেটে ছাতার কাজ সারছি। তার মধ্যে খুব সুন্দর করে, খুব অবারিত করে রাখা হয়েছে রেলিকস্‌সকল, লম্বা মনোহর দেয়াল আর পাশে তিনটে ছোট্ট চোর্তেন ডিঙিয়ে উল্টোদিকে প্রাসাদের জন্যে উপাসনা মন্দির।
কুয়াশার মণ্ড ভেসে যাচ্ছে আমার আজু-বাজু দিয়ে, অল্প জলে নিরামিষাশী বিস্কুট তৈরির আগে যে মাখা-টা হয়, মেঘের সেই “ড” গড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বৃষ্টির মেশিনে। টের পাই, প্রকৃতির মূল গ্রন্থিগুলো এখানে খোলা, নগ্ন, উচ্ছ্বসিত, যেন নিজের ঘরের উঠোনে বসে আছে। আর রাগি পি.টি. টিচার বাতাস পাইন গাছগুলোকে ডাইনে-বাঁয়ে দুলিয়ে ফ্রিহ্যান্ড করিয়ে নিচ্ছে খুব।
ধ্বংসস্তূপের ওপরে উঠে এসে প্রথমটা এত লাল রেলিং, পরিচ্ছন্ন ছাঁটা ঘাসের ওয়েল-বিহেভড খন্ডহর দেখে মুষড়ে গেছিলাম। কোথায় সেই গিরগিটি-পালানো, দু’শতাব্দী সাবানস্নানহীন অতীতের হাড়পাঁজর? তারপর মনে হল, অস্তিত্বের তো এমনই ঝকঝকে থাকার কথা যখন সে ভয়ানক পুরাতাত্ত্বিক জঙ্গলের অতীত পার হয়ে আসতে পেরেছে।
নিসর্গের ফার্মহাউজ এটা। পাহাড়ের কনফারেন্স হল। এখানে প্রকৃতি উৎপন্ন হয়ে দিকে দিকে পরিবেশিত। আমি নিসর্গের কোর এরিয়ায় এসে তার খেলার কোর্টেও ঢুকে পড়েছি, আর রেগে গিয়ে আমকে এক্ষুনি মোর করে দিতে চাইছে সে। সারা সশরীরে বৃষ্টির বাড়ি খেতে খেতে বুঝতে পারলাম, রাজধানী ও হাভেলি এখনও অসাধারণভাবে বর্তমান। বেনডেন্টসে রাজবংশের হাত থেকে তাকে শুধু কেড়ে নিয়েছে পাহাড়ি প্রকৃতি।
সাত
রোদ ফিরেছে। গাড়ির কাচ নামিয়ে মনে হয় এই ফার্ন আর ঘাসফুলের অসহায় দোদুল্য পাইপ বা খদ্দেরহীন দোকানের চাউমিন, এরা কি আমার কখনও কেউ ছিল, বন্ধু বা আত্মীয় লাগত আমার? অথবা আমিই ভেতরে ভেতরে ওই কানঝোলানো লোমাতিশয় খুদে খুদে চারটে পা? বাচ্চা ছেলের ঠোঁট থেকে প্রকাশিত ভোর-কুয়াশার সিগারেট?
রোদ ফিরেছে। কিন্তু, নিজের সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এমন এক অনবদ্য ঘটনা, সরষে থেকে তেল বেরিয়ে যাওয়ার মতো। তেলকল মালিক বেঁচে থাকতে এ-সম্ভাবনা হারিয়ে যাওয়ার নয়। কাজেই, আমি সিদ্ধান্তে এসে পড়ি যে, ঈশ্বরভাবনায় যেমন, প্রেমেও নিজেকে নিজের চেয়েও বড় অন্য কিছুর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া, নিজের কেন্দ্রকে অন্যের ভেতরে দেখে চাওয়ার ইচ্ছেই সত্তার সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছে। পালপোষ করেছে হীনমন্যতাকে। তাই প্রেম ভেঙে যে ভীষণ নেগেটিভ শক্তি জন্ম নেয়, তার সাহায্য নিয়ে সত্তার অখণ্ডতাই গড়ে ওঠে একটু একটু করে।
অণু তৈরির সময়ে পরমাণুর ঘরগুলো ওভারল্যাপ ক’রে যায় তো অন্য একটার সঙ্গে? আর যে পরমাণু যত অস্থায়ি, সে ততো ওভারল্যাপে যেতে চায় স্থির হবে বলে? এভাবে যে যৌগ তৈরি হল তাকে আমরা প্রেম ডেকেছি। একই নিয়মে, যতরকম নাম রয়েছে সম্পর্কের --- ভালোবাসা, বিয়ে বা মুক্ত যোগসূত্র --- তার মধ্যে সেটাই সেরা যেখানে দুজনে সমানভাবে দুটো ইলেকট্রন-মেঘ নিজেদের শরীরে মেখে নেবে। তো, আমার এমন সত্তাজোড় যখন ভেঙে গিয়েছিল, বুঝতে পারিনি, কেউ বোঝে না, কোন টুকরোটা আমার, কোনটা ওর! যে অংশ যন্ত্রণায় চিৎকার করছে, সেকি আমি, না ও? যে ফালিটা দ্রুত অন্য সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে পড়ে ভুলে যেতে চাইছে অতীত, সে কি ও, না আমি?
এইসব ভেবে আমি দেখি, ড্রাইভার এক-কিরণ শূন্যতার কাছে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে। কখন ঝটকা মেরে তুলোর ঝালর সরে যাবে, করোটির সাদা নিয়ে বেরিয়ে আসবে চূড়াগুলো আর নিচে অনেক সন্ততির মতো ঝাউগাছ --- জানে না মানুষ। সেখানে অনেকে একসাথ হয়ে ছবি তুলছে পাহাড়ের, মুখে বিস্ময়ের এককোটি প্রতিশব্দ!
তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম, তোমরা উলটো দিকে লেন্স ঘোরাও, যেহেতু কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়ে অনেক দেশবরেণ্য ঘটনা এখানে দাঁড়িয়ে। প্রচুর কম শক্তির সে, উচ্চতা নেই, বাইনোকিউলার-ভর্তি সৌন্দর্য নেই, যে কোনও উড়ান তার মাথা ডিঙিয়ে যায় আরামসে। সে আহত হলে কোনও পরিবেশবিদ্যা ছুটে আসবে না, তবু ওই তুষারচুড়োর চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক বৃষ্টিমারুৎ, চক্রবাত আর সৌদামিনী তাকে ঢেকে দিয়েছিল। হাত ধরে সসম্মানে পৌঁছে দিয়েছিল মেট্রোর তৃতীয় রেলে, শার্টের পকেটে নতুন-কেনা ব্লেড গুঁজে দিয়ে ঘরের দরজায় বাইরে থেকে হাঁসকল টেনে বেরিয়ে গিয়েছিল বড় রাস্তায়। সেই সমস্ত নশ্বর সূর্যাস্ত সামলে, অর্ধেক হয়েও পূর্ণের নাম ধ’রে বেঁচে থাকার জন্যে সে এখনও আছে।
তোমরা তার ছবি তোলো, বন্ধুগণ।

রিশিখোলা মুক্তি মোর্চা

রিশিখোলা মুক্তি মোর্চা
এক
‘ছোটিসি বাত’ ছবিতে অম্ল পালেকারের (আদর করে ডাকি) দশা ছিল অনেকটা আমার মতো।
শেয়ারের জিপ রিশি নদী পার হয়ে চেকপোস্টে দাঁড়ালে এ-ফোর কাগজ-রূপী চৌকো পাতলা কনস্টেবল গাড়িতে বিদেশি সওয়ারি নেই দেখে গেট খুলে দিল, জিপ সিকিমের ভেতরে ঢুকে থামল স্টপেজে। নেমে এসেছি, কিন্তু যাবোটা কোথায়! আধা-আর্ত ফোন কল ধরে ইকো-ট্যুরিজমের মালিক যা বললেন: পথই পথ দেখাবে, এগিয়ে আসুন।
ডিরেকশান বোলে তো প্রথমে একটা নুড়ি-পেছল শুঁড়িপথ ধরে নেমে যাওয়া, কোমর আর হাঁটু --- দুই নিজ-লাগেজের দায়িত্বসহ। নিচে রিশিখোলা, যাকে টপকে আপনাকে পুনরায় ‘পচ্চিমবঙ্গে’ ঢুকে পড়তে হবে। একটা যত-সরু তত-নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পার হতেই বনপথ চট্টানে চট্টানে ঢাকা। তার গায়ে তীরচিহ্নের ছোটিসি বাত --- ইকো-কটেজ আর মাত্র বারো মিনিট।
এই সেই পঞ্চবায়ুর শুরু যা আসলে একটা সবুজ-বাদামি খাম। এই সেই সহজ সুর যার ওপরে পা রাখা চলে। পাখির উড়ে যাওয়ার ডাক, পাতা ঝ’রে পড়ার আলো, আর অহেতুক অনাস্বাদিত বুনোফুল। ডানদিকে রিশি-র মাথায় বুকে কোমরে পায়ের পাতায় অজস্র ঘুঙুর, কারণ সে জলের চেয়ে অনেক বেশি নিসর্গ-সংবাদ বয়ে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে। তার পাড়ে মাথা নিচু হাঁটতে হাঁটতে টের পাই, দুপাশের পাহাড়ে সার লাগানো চিলোনি গাছের প্রত্যেকটা আসলে লামা পিস্তল তাক করা জলপাই উর্দির জওয়ান, পাথরের গায়ে ‘কিপ দিস প্লেস ক্লিন’ শব্দাবলীর মানে ‘ফেরার রাস্তা খুঁজো না’। আমি যুদ্ধাপরাধীর চেয়েও শোচনীয় অবস্থায় --- আমি প্রকৃতিবন্দী!
সাদা প্রজাপতি কোনও শান্তিসংকেত ছাড়াই উড়ে বেড়ায় চারপাশে, যেন আমার পরমায়ু একটা পরিপক্ক ফলের মতো হয়ে গেছে। আরও দেখি, বন তার গায়ের ঘামের গন্ধ পাল্টায়নি সেই ছোটবেলা থেকে, এবং একটু পরেই লম্বা হেলানো শীষওলা ঘাসের ব্যারাক আত্মপ্রকাশ করে। এক কাঠবাড়ির দোতলায় আমার সলিটারি কনফাইনমেন্ট, চোখের ঠিক নিচে তখন বিঠোফেন বাজাচ্ছে রিশিখোলা।
দুই
তুমি তো এখানে আসবেই কোনওদিন পুরুষবন্ধু নিয়ে; জানলা দিয়ে যখন দেখবে ক্ষয়াটে দুপুরে হাঁটুডুব নদীতে ডানা-শুকনো স্নান সারে বাচ্চা আর মা, বাবা দূরে ক্যামেরাধারী এবং নদীর ওপর কিছুটা বিরক্ত, তাকে ঠিকঠাক অ্যাঙ্গেল দিতে পারছে না ব’লে --- বুঝে নিও একটা প্রকৃতিপীঠ সামান্য পিকনিক স্পটে পর্যবসিত হয়ে কী মরমে মরেছে! সেই ধারা ধরা থাকবে কেটারিং কেতার দুপুরাহার পর্যন্ত, পরিবারশক্তিতে ভারি জনসমাজ যেখানে ডাইনিং রুমে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে খাদ্যশিকার করছে।
বুদ্ধিমান লজ-মালিক মুখে হাসি আর চোখে প্রশ্ন রেখে আমাকে বসায় বেলা গড়ানো ফাঁকা খাবার-টেবিলে। যেন আমি সিলসিলা-র লম্বা লোকটা যাকে গুরদোয়ারা পর্যন্ত প্রশ্ন করছে, ‘তুমি’ কোথায়? বলতে পারি না, তোমার সঙ্গে দেখাই হয়নি আমার কোনওদিন; প্রত্যেকটা সাক্ষাৎকার মহাশূন্যের অসংখ্য নেগেটিভ কণিকার মতো গড়েছে, ভেঙে গেছে।
ভাবতে ভাবতে নদীর বাতাসে টেবিল-ঢাকা উড়ে গিয়ে আমার ‘খানা খারাব’ আর মন ভালো করে দিল। কবে কোথায় এমন হয়েছে যে নুপূরের প্যাঁচ খাওয়া শুকনো পাতা অন্যমনস্ক দোয়েলের মতো নেমে এল ডালের বাটির পাশটায়? কিন্তু ছায়াছবির যে অংশ তখনও বাকি, খোলা উঠোনের বেসিনে হাত ধুতে মুখ নিচু করামাত্র দেখতে পাই --- বেসিনের নিচে জল বয়ে যাওয়া নালি বোগেনভেলিয়ার হলুদ পাপড়িতে ভরে আছে, ঝরা গোলাপের মেরুন ফুল ভেসে যাচ্ছে আমার কুলকুচি করা জলে! পৃথিবীর আর কোনও নর্দমা পুষ্পবৃষ্টিতে উপচে ওঠে বলে আমি তো জানি না...।
তিন
বিকেলে ধুম জ্বর এল। ঘরে চা দিতে এসে এগারো বছরের মহেশ সুব্বা (নাম, বয়েস আর দুষ্টুমির বিবরণ অপরিবর্তিত) টেনে তুলেছে আমাকে। তারপর এই রোগগ্রস্ত বুড়ো ছেলেকে ভোলাতে সে ছোট্ট ছোট্ট ফড়িং ধরে আর ‘দ্যাখো দ্যাখো’ বলে ফুঁ দিয়ে বাতাসে ওড়ায়।
--- ডানাগুলো ছিঁড়ে দিস না যেন!
মহেশ হাসতে থাকে।
--- জ্বর হয়ে তুমি কি অন্ধ হয়ে গেলে?
তাই তো! এইটুকুটুকু বাদামি ত্রিপত্র, তাদের বন্ধনী থেকে পাতাগুলো ওপরে উঠে আছে ব’লে ভাসিয়ে দিলে উড়ন্ত টেবিলপাখা বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় অনেকদূর।
--- কী গাছের পাতা রে!
মহেশ মাটি থেকে তুলে দেখায় --- মৌয়া।
গতিষ্ণু প্রকৃতির ভেতরে এসে পড়েছি। নদী শুধু নয়, গাছ পথের নুড়ি সবাই হাঁটতে জানে এখানে। দৃশ্যত মৌন, কিন্তু নানা শব্দ শোনা যায় আকাশের।
সকাল সাড়ে ছ’টায় ঘরে ঘরে চা পৌঁছে তার দিন শুরু। তারপর ব্রেকফাস্ট রেডি হলে দরজায় ‘ঠকঠক’ দিয়ে আসা, পাতা কুড়োনো, জল তোলা, ফাইফরমাস --- এভাবে চার বেলা-ই...কখন স্কুলে যাস তুই!
কান না দিয়ে মহেশ বিছানার ওপর থেকে আমার খাতাটা টেনে নেয়: কী লিখেছো, পড়ো।
মণীন্দ্র গুপ্ত জিগেস করলেও আমি একইভাবে ব্লাশ করতাম।
--- ও এমন কিছু না, বাদ দে, বাদ দে...তাছাড়া তুই তো বাংলা জানিসই না।
--- কে বলল? সব ভাষা শেখা আছে। বাংলা, হিন্দি, নেপালি, ইংলিশ, জাপানি, চাইনিজ, এস্পা...এস্পা...।
স্প্যানিশ নিশ্চয়ই! গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ-এর তরফ থেকে ওর দুটো খোসাওঠা গোলাপি গাল টিপে দিয়ে বলি: কলকাতা যাবি আমার সঙ্গে? চল।
---কলকাত্তাকা নাম ভী মত লেনা, শা-লা!
মহেশের ওপর আমার শ্রদ্ধা এক সেকেন্ডে ছ’গুণ বেড়ে যায়...।
(চলিবেক...)

পৃষ্ঠা বনাম প্রচ্ছদ

পৃষ্ঠা বনাম প্রচ্ছদ
এক
আমার মনে একটা রূপকের কল্পনা আছে --- যে-কোনও দেশই একটা কিতাব। সেই বইয়ের পাতাগুলো হচ্ছে জনগন আর মলাট রাষ্ট্র
তাহলে দাঁড়াল যে, নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কনটেন্ট আর কাভার-এর। প্রচ্ছদের ছবি, রঙ বা লেটারিং, সেটা পেপারব্যাক হবে না শক্ত মলাটের --- বইয়ের বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করার কথা। অথচ, বাস্তবে বাধ্যতামূলক নির্ভরতার গল্পটা ঠিক উলটোরকম
ভেবে দেখুন, প্রচলিতভাবে আমরাও সবসময়রাষ্ট্র জনগনউচ্চারণ করে থাকি, মানে, ঘোড়ার আগে জুড়ে দিই গাড়িটাকে। কাজেই এটা মেনে নিতেই হবে যে, রাষ্ট্রের পরিচয়েই নাগরিকের আইডেন্টিটি। আমেরিকা দাদাগিরি ফলানো একটা দেশ, কারণ সেই দেশের রাষ্ট্র দাদাগিরি করে। পাকিস্তান ভারতবিদ্বেষী, কেননা সে দেশের সরকার ভারতকে মোটেই পছন্দ করে না --- ব্যাপারটা এই রকম। এই প্রক্রিয়ায় আস্তে আস্তে শীত জাঁকিয়ে বসে, তারপর বইয়ের পাতাগুলো ঝরে যায়; ফুটপাথের দোকানের ফিস কাটলেটের মতো মলাটসর্বস্ব হয়ে পড়ে দেশেরা
দুই
এতদিন দুই দেশের যুদ্ধ বলতে আমরা জানতাম, এক মলাটের সঙ্গে অন্য মলাটের ধাক্কাধাক্কি। কিন্তু আধুনিক সন্ত্রাসবাদ এসে লড়াইয়ের নিয়মে বদল এনেছে। সন্ত্রাসবাদী সমর মানে এক বইয়ের প্রচ্ছদের সঙ্গে অন্য বইয়ের পৃষ্ঠাগুলোর সংঘর্ষ। (জঙ্গী সংগঠনকে প্রচ্ছদ বলছি এই জন্যে যে তার চরিত্র অবিকল রাষ্ট্রেরই মতো)
এই হামলায় সাধারণ মানুষ পড়ে দুটো অসুবিধেয়। ) সে অরক্ষিত, সফট টার্গেট বলে বেঘোরে প্রাণ হারাতে থাকে। ) তার নিজের রাষ্ট্রও সুযোগ পেয়ে যায় আর একটু জাঁকিয়েবসার। যে-কোনও সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পরে নির্বিচার ধরপাকড়, অমানবিক অর্ডিন্যান্স তৈরি করা বা নিরাপরাধ মানুষের হয়রানি সে কথা প্রমাণ করছে
ফ্রান্সে টেররিস্ট হামলার দিন কয়েকের মধ্যে ফরাসি সরকার বিনা বাধায় কয়েকটা নতুন আইন পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে নেয়, যেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় প্রণয়ন করতে তাদের কালঘাম ছুটতো। একটা অর্ডার অবশ্যই বর্ডার সিল করে দেওয়া, পাশাপাশি বন্ধ হল ফ্রান্সে সব রকম শরণার্থী প্রবেশ। কাজেই, যে সিরিয় উদ্বাস্তুরা সে-দেশে জায়গা পাচ্ছিল, তাদের চোখে কোথাও ফ্রান্স আর আইসিস-এর ভূমিকা হয়ে উঠল সমান-সমান!
আমার কাছে জঙ্গী হামলার সবচেয়ে ভয়ানক প্রভাব এই যে, জনগনের ভূমিকা ছোট হয়ে আসতে আসতে একেবারে মুছে যাওয়ার অবস্থা হয়। আগেকার ধ্রুপদী যুদ্ধে বিজিত দেশ ক্ষমতা হারাতো, জয়ী দেশ সেখানে কলোনি তৈরি না করলেও অর্থনৈতিক সুবিধে ছিনিয়ে নিত অনেকখানি --- তার উল্টোদিকে গিয়ে সন্ত্রাসবাদী লড়াইতে দুটো রাষ্ট্রই ক্ষমতা বাড়িয়ে নিচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্বময় শক্তিশালী হচ্ছে রাষ্ট্রব্যবস্থা। ভালো প্রকাশন সংস্থার বইতে আমরা দেখেছি, এতো সুন্দর মানের কাগজ-ছাপা-বাঁধাই থাকে যে, হালকা সুচারু পেপারব্যাক কাভারেই বইটা সুরক্ষিত। ঠিক তেমনি রাষ্ট্রেরও লক্ষ্য হওয়া উচিত সে-দেশের নাগরিকের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হয়ে ওঠা। কারণ, সংস্কৃতি শব্দটার পেছনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাম্য আর অধিকারের ছবি উচ্চারিত
তা না হয়ে স্টেট হয়ে দাঁড়াচ্ছে মিলিটারি-মুখ, দেশের বাইরে, দেশের মধ্যেও। সেই ফাঁকে 'জনগন' নামের পাবলিক প্রপার্টি লুঠ হয়ে যাওয়ার জোগাড়!
তিন
মিশেল ফুকো- সঙ্গে একবার আলোচনায় বসেছিলেন পিয়ের ভিক্টর (ফুকোরনলেজ/পাওয়ারবইয়ের প্রথম লেখাটা) এই ভিক্টরেরই আরেক নাম বেনি লেভি, যার নেওয়া জাঁ পল সার্তের সাক্ষাৎকার কবি অরুণ মিত্রের অনুবাদেশেষ সংলাপনামে আমরা অনেকেই পড়েছি। বৃদ্ধ সার্ত-এর ওপর মাওবাদী লেভির প্রভাব এতোদূর ছড়ায় যে সিমোন দ্য বোভোয়াও সেই বাড়াবাড়ি নিয়ে বিরক্ত মন্তব্য করছিলেন
যাই হোক, ভিক্টরের সঙ্গেপপুলার জাস্টিসনিয়ে মিশেল ফুকোর মত কিছুতেই মিলছিল না। ১৯৬৮- ফ্রান্স সেটা, বিপ্লবী জন-আন্দোলন চলার সময় সর্বহারা জনতা কিভাবে জনগনের শত্রুর বিচার করবে সেই বিষয়েই ভাবনা-চিন্তা চলছে দুজনের। ভিক্টর চাইছিলেন, চিনা মডেল অনুসরণ করে দুই দলের মধ্যে চায়নার রেড আর্মি- মতো একটা মধ্যস্থতাকারী কোর্ট বসানো হোক। আর ততোবারই ফুকো বলতে থাকেন, কোর্ট মানেই সে বুর্জোয়া ইডিওলজি ঢুকিয়ে দেবে সর্বহারার মনের ভেতর। যেমন বুর্জোয়া কোর্টের কাজই ছিল সর্বহারা লুম্পেন সর্বহারার মধ্যে দূরত্ব তৈরি করা। সারা জীবন ধরে প্রান্তিক মানুষদের প্রতি অসীম মমতা-মাখা মিশেল ফুকো একবারও লুম্পেন শব্দটা উচ্চারণ করেননি ইন্টারভিউতে (ভিক্টর একবার বলেছিলেন), সারাক্ষণ ডেকে গেছেনআনপ্রলেতারিয়েত মোট কথা, বিপ্লবী জনতা আর তার প্রতিপক্ষের মধ্যে কোনও তৃতীয় শক্তিকে থাকার জায়গা ফুকো দেবেন না
কানহাইয়া কুমারের ওপর সরকারি কোর্ট চত্ত্বরে যখন আইনজীবীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তখন মনে পড়ল ঘটনাটা! খুব দুঃখ হল। শেষ পর্যন্ত মধস্থতাকারীরা বিদায় নিতে চলেছে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা থেকে, উনি জানলে যে কী খুশি হতেন!
চার
রাষ্ট্র একটা আইনস্বীকৃত অস্তিত্ব। সাধারণভাবে, জনগন আর রাষ্ট্র মিলে দেশ হয়। পৃষ্ঠা আর মলাট একসাথ হলে বই --- যে রূপকের ব্যবহার আগে করা হয়েছে। দেশ স্বতঃস্ফূর্ত অস্তিত্ব। ভারতীয় গণতন্ত্রে দেশকে দেখাশুনো আর চালানোর দায়িত্বে কোনও সরকার নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্যে। এরা আসলে এক বা এ্কাধিক রাজনৈতিক দল। তাহলে রাজনৈতিক দল বদলে গেল রাষ্ট্রিয় সরকারে
কিন্তু রাষ্ট্রিয় সরকার কি রাষ্ট্রে বদলে যেতে পারে? না, কখনওই নয়। চেয়ার খালি হয়েছে, আমি গিয়ে বসলাম। তাতে আমি চেয়ারটা হয়ে যাই না কিন্তু
রাষ্ট্রের প্রতিনিধি সরকার নয়, সংবিধান। সরকার জনগনের প্রতিনিধি
রাষ্ট্রিয় সরকার সেই বাঁধাইয়ের মতো, কনটেন্ট আর কাভারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা রাখা যার কাজ। যেহেতু রাষ্ট্র এক স্থির ধারণা আর নাগরিক একটা পরিবর্তনশীল মূল্যবোধ, এবং পৃষ্ঠার লেখা পালটে গেলে প্রচ্ছদের গঠনও অন্য হয়ে যাবে, তাই জনগনের ইউনিয়ানের নেতা হিসেবে সরকারের দায়িত্ব হল সময়মতো রাষ্ট্রিয় কাঠামোতে বদলাও আনা
কিন্তু মুশকিল এই, সব প্রতিষ্ঠানের মতো সরকারও এক লাভজনক সংস্থা। ভৌগোলিক আয়তন, মিলিটারিবাহিনি আর অর্থনৈতিক শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে স্থায়ি হয়ে উঠতে চায় সে। প্রতিষ্ঠান চাইবে অধিকাংশ নাগরিককে তাদের গ্রাহক বানাতে। প্রত্যেক রাষ্ট্র, মানে অন্তর্গত সরকারেরও মেজরিটির মন পাওয়ার নিজস্ব প্রকল্প আছে। খবরের কাগজের লক্ষ্য যেমন সবচেয়ে বেশি কাটতি, সরকারের উদ্দেশ্য সর্বাধিক ভোট। অথচ, সমাজে যে মতটায় বেশির ভাগ মানুষহ্যাঁদেয়, সেটা যে সেই সময়ের সবচেয়ে এগিয়ে থাকা চিন্তা নয়, -ব্যাপারে সন্দেহ থাকতে পারে না
পাঁচ
সি পি আই-এর ছাত্র সংগঠন এআইএসএফ নেতা কানহাইয়া কুমার। সাম্যবাদী তত্বে নিপীড়িত জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। লেনিনবাদে রয়েছে এই তত্বায়ন। সেখানে এও উচ্চারিত যে, কমিউনিস্ট পার্টি সেই লড়াইতে অপ্রেসড ন্যাশানালিটি- হয়ে অংশ নেবে। তার সঙ্গে যোগ করুন নয়া-উপনিবেশ তত্ব আর সাব-অল্টার্ন দৃষ্টিভঙ্গি --- পেয়ে যাবেন বেগুসরাইয়ের বিহাট গ্রামের ছেলেটাকে। যে হয়তো বিশ্বাস করে, কাশ্মীরের জনতা ভারত সরকারের হাতে শোষিত হচ্ছে, তাদের ন্যায্য স্বাধীনতার দাবীর সমর্থক কেউ না, না ভারত, না পাকিস্তান
কিন্তু তাহলে কানহাইয়া কুমারকে জেলে পোরার আগে ভারতের সব সাম্যবাদী দলগুলোকেই তো নিষিদ্ধ করতে হয়!
ভাবুন, সুবাস ঘিসিং-এর নেতৃত্বে যখন দার্জিলিং-এর নেপালি জনগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রাথমিক দাবী তুলেছিল, তখন তাদের সমর্থন করারই কথা কানহাইয়া কুমারের পার্টির। কিন্তু রাষ্ট্র-সরকার গত শতাব্দীর আশির দশকে মনে তেমন কোনও আশঙ্কা তো রাখেইনি, উলটে আত্মবিশ্বাসী ছিল, সংসদীয় গণতন্ত্রে নাম-লেখানো রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা সাম্যবাদী দলগুলোর জোট-সরকার সেইবিচ্ছিন্নতাবাদীআন্দোলন সুচারু হাতে থামিয়ে দেবে
তবে, আজ জে এন ইউ-এর একমুঠো ছেলেকে ভয় কেন?
জানুয়ারি মাসে দিল্লি গিয়েছিলাম। মোবাইল ফোন হারিয়েছি, একটা পুরনো সিম কার্ড সঙ্গে ছিল, কিন্তু তার নম্বর মুখস্থ নেই। রিচার্জ করাতে দোকানে গিয়ে দোকানদারকে অনুরোধ করছি, ভাই, আপনার মোবাইল নম্বরটা বলুন, একটা রিং করবো, আপনার সেট- আমার নম্বর উঠে যাবে, তারপর রিচার্জ করিয়ে দিন
মহাবীর এনক্লেভ-এর গোটা বাজার ঘুরলাম, কোনও দোকানদার রাজি হয়নি
আমি টেররিস্ট হতেই পারি, আমাকে মোবাইল নম্বর দিয়ে ফেঁসে যাওয়ার বান্দা কেউ নয়। বা, হয়তো আমার সেটটা ট্রিগার করবে একটা বিস্ফোরণকে, কে বলতে পারে!
সেবার দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে সেমিনার শুনতে গিয়ে দেখি, প্রফেসরদের প্যানেল ডিসকাশানে মুসলিম সমাজজীবনে রাষ্ট্রিয় শোষণ নিয়ে ডঃ দুবে বলছেন, পরে স্কলারদের মধ্যে কাশ্মীরের ছাত্র আসিফ লেন পেপার পড়ছেন সে ব্যাপারেই। আর একটি দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই গবেষক, নাম সম্ভবত মীনাক্ষী, তার থিসিসের বিষয় কাশ্মীরের দৈনিক কাগজের রাজনৈতিক কার্টুনিস্ট মালিক সাজাদের লেখা সেই মহাবিতর্কিত গ্রাফিক উপন্যাসমুন্না: বয় ফ্রম কাশ্মীর”, যা ভারতীয় প্রকাশন সংস্থার কাছে প্রত্যাখ্যান পেয়ে আশ্রয় করেছিল হার্পার-কলিন্সকে
তখনই বুঝতে পারি, আমাদের রাজধানীর তরুণ বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশে প্রো-মাইনরিটি মনোভাব দারুন জায়গা করে নিয়েছে। প্রশ্নোত্তর পর্বেসম্ভবত মীনাক্ষীকে কিছু কথা জিগেস করলাম, ডায়াস থেকে নামার পর আলাপ হল আসিফের সঙ্গে। ওরা প্রত্যেকে থিয়োরিস্ট, কিন্তু প্রতিবাদী, সামাজিক ইস্যুগুলোকে মনের মধ্যে নাড়ে-চাড়ে, আদর্শবাদের চোখ দিয়ে দ্যাখে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে আর তার হাজার ত্রুটি খুঁজে পায়। ওদের অভিজ্ঞতার অভাব আছে, হঠকারী ভাবনাওকিন্তু ছেলেমেয়েরা কেউই দেশটাকে ঘেন্না করে না, চায় না তাকে নষ্ট করতে। এটা সত্যি যে টেররিস্ট গ্রুপগুলো এদের মধ্যে নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ খুঁজবে, কিন্তু কেউ ধর্মীয় মৌলবাদীর সঙ্গে দেশের সবচেয়ে মেধাবী, শিক্ষি্ত, সাহসী, চিন্তাশীল জনগোষ্ঠীকে এক দাঁড়িপাল্লায় মাপলে আমি তাকে মহাবীর এনক্লেভের সেই মোবাইল দোকানদারের চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারবো না
ছয়
যে গণতন্ত্র যতো বেশিঅবাধ্যতাসহ্য করতে পারে, সে ততো শক্তিশালী
প্রতিষ্ঠানের একটা ফোলানো-ফাঁপানোইগোথাকে। এই অহং ঠিক মুদ্রার মতো যার মুন্ডুতে ক্ষমতার দম্ভ আর লেজে ক্ষমতা হারানোর ভয়। প্রতিভাবানেরা প্রতিবাদী বলে প্রতিষ্ঠানে না ঢুকে স্বাধীনতা বাঁচিয়ে রাখেন, অথবা প্রতিভাবানেরা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়লে ওদের নিয়মকানুন মেনে যথাবিহিত ভোঁতা হয়ে যান দুচারদিনে --- এমনই জানা গেছে
কিন্তু আর-সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্র-সরকারের একটা বড়ো তফাত এই যে, আপনি ইচ্ছে করলে টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু সরকারকে সুইচ অফ করা যায় না। তাছাড়া, অন্য যে কোনও প্রতিষ্ঠানের একটা টার্গেট অডিয়েন্স থাকে; সরকারের আওতায় দেশের সব মানুষ, জীবজন্তু, প্রাকৃতিক সম্পদও
একটা দেশে যে কোনও ইস্যুতে অধিকাংশের মত এক রকমই হয়। গণমাধ্যম তাকে সমর্থন করে, সরকারও তারই পৃষ্ঠপোষক। (যদিও মিডিয়া আর সরকারের স্বার্থ সবসময় এক হয় না, সে আরেক আলোচনা) এই মতগুলো স্থিতাবস্থার পক্ষেই থাকে। যেমন, খুনি বা ধর্ষককে ফাঁসি দাও, অথবা, আমার দেশের সঙ্গে অন্য কারও যুদ্ধ হলে যে অন্য দেশটাকে সমর্থন করছে সে দেশদ্রোহী
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতের সঙ্গে অ্যাকাডেমিয়ার দৃষ্টিভংগির একটা তফাত থেকে যাবেই। দ্বিতীয়টা অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ, শিক্ষিত, আধুনিক আর নমনীয় হবে। কাজেই, যে কোনও ইস্যু নিয়ে ভাবার সময়ে তাদের হাতে অপশান থাকবে অনেক বেশি। ভবিষ্যত-সমাজ কেমন হতে চলেছে, তার অনেকটা ইশারা এদের ভাবনায় ধরা থাকে। উল্টোদিকে, প্রতিষ্ঠান পপুলার ম্যানডেট আর ইগো, এই দুই পায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যে যে কোনও বিরোধাভাসের সামনে তার প্রাথমিক অপশান মাত্র একটা --- না!
খবরের কাগজে পড়লাম, জে এন ইউ-এর দুই ছাত্রনেতা অনির্বান আর উমর ধরা দেওয়ার পর দিল্লি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের সময় যা বলেছে, অফিসারদের মাথায় তার বিন্দুবিসর্গও ঢোকেনি। এখানেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিত হয়ে ওঠার দরকারটা এসে পড়ে। শিক্ষা থাকলে তাত্ত্বিক লড়াইয়ের আখড়া হয়ে উঠতে পারত জেএনইউ বা যাদবপুর ক্যাম্পাস; ধরপাকড়, উকিলি মারধর, হাইকোর্ট, দেশদ্রোহিতা --- বেকার বসে থাকত। তা না হয়ে স্থূল আর সূক্ষ্মকোনে ভাগ হয়ে গেছে পৃথিবী --- পপ মিডিয়া বনাম অ্যাকাডেমিয়া; সাব-অল্টার্ন ভার্সাস স্মৃতি ইরানি
কানহাইয়া কুমার তো ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের বাইরে একটা শব্দও বলেনি। বলা তার কাজ। কর্মবীর হতে গেলে কানহাইয়ার পার্টিই পেছন থেকে শার্টের হাতা টেনে ধরবে। বরং ওর এই কথাটা বেশ ভালো লাগল --- ভবিষ্যতে নেতা নয়, অধ্যাপক হতে চাই। এখন সমাজ-পরিসরে ওই অ্যাকাডেমিক জগতেই একমাত্র কিছু নতুন ভাবনাচিন্তার জায়গা খোলা আছে
জুডিথ বাটলার আর গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক-এর একটা বই পাওয়া যায়: ‘হু সিংগস দা নেশন-স্টেট?’ যেখানে বাটলার, যে-শক্তি জোর করে রাষ্ট্রের সঙ্গে জাতিকে জুড়ে দেয়, তার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। বলেছেন, জাতি-রাষ্ট্রের ধারণারাষ্ট্রহীন মানুষনামের বিভাগ তৈরি করে, টেনে এনেছেন হানা আরেন্ড-কথিতজাতীয় সংখ্যালঘুটার্মটাকে

কিন্তু ছোট্টোখাট্টো কানহাইয়া কুমারকে আকাশের দিকে সৌন্দর্যময় তর্জনী তুলেআজাদি’- শ্লোগান দিতে শুনে মনে পড়ছিল একটা লাইনই যা অন্য প্রসঙ্গে এই বইতেই বলেছেন জুডিথ, “পাওয়ার ইজ নট দা সেইম অ্যাজ