Sunday 24 August 2014

লাভা-র বয়

লাভা- বয়
এক
তুমি আমাকে বলেছ, লেখো, লেখোই না! সারাদিন এতো যে বকবক 'রে আমার কানের পোকা নড়িয়ে দাও, তা শুধু একাই কষ্ট পাবো কেন? দু-পাঁচশো লোক অন্তত বুঝুক কী গেরো আমার!

বৃষ্টি হচ্ছে, তবে আসি-যাই-মাইনে-পাই ধরণের দায়সারা বর্ষণ ধরো, তবলায়  "তেরেকেটেতাক তেরেকেটে" যেমন মেরেকেটে হালকা প্র্যাক্টিস একটা এদিক-সেদিক কাঠ-খোলা ঝোলানো ব্রিজের ওপর 'সে আছি নিচে বোল্ডারে জলধাক্কার রাগিনী শোনানো চেল নদী, স্থানের নাম গরুবাথান সেখানে কষ্ট-কষ্ট মুখ 'রে বসা আমি মনের কানে শুনলাম, তুমি এবার আঙুল তুলে শাসাচ্ছো --- লিখবে কিনা!

এখান থেকেই রাস্তা তার পিঠ সোজা 'রে দুপাশের পাইন-জঙ্গলকে ইন্সপায়ার 'রল, চল চল পাহাড়ে উঠি যেন রাখাল গরুর পাল 'য়ে যায় মাঠে এবং লাভা- উঠেও পথ যদি শেষ না হয়, কেউ কেউ সেই "চু" 'রে একই দমে কালিম্পং! তোমার সঙ্গে ঝগড়া 'রে অল্প কিছু কারেন্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম, ট্রেকার ছাড়বে বিশ সাল বাদ বিশ বোলে তো তিন ঘন্টা আগাম সিট বুকিং আমার পকেটে --- পঞ্চাশ টাকা পঞ্চাশ টাকা পঞ্চাশ টাকা  উত্তর কলকাতার বনেদি চালে একবার ভাড়ার প্রাইভেট কারের গায়ে হাত রাখতে গেছিলাম, কারেন্ট খেয়ে পালিয়েছি ভাড়া আটশো ওনলি, আপনার কথা-বার্তা ভালো লেগেছে 'লে একশো নামিয়ে দিলাম নিকুচি 'রেছে ভালো লাগার!

কত রকম দোকান গরুবাথানের ছোট্ট বাজার এলাকায়! তার কোনও একটিতে গিয়ে দাঁড়ালেই হাতে কার্ড ধরিয়ে দিচ্ছে --- লাভা যাবেন কি? এই মোবাইল নাম্বারে ফোন করলে আমারই ভাই, সস্তায় ভালো হো...  খাতার বদলে ছাতা নিয়ে ঘুরছিলাম, বৃষ্টিতে মাথা বাঁচানোর কাজে এর অভিজ্ঞতাও কিছু ফ্যালনা নয়! তাছাড়া, কখন শ্রাবণধারার সঙ্গে মিশে দু-একটা কবিতার লাইন 'রে পড়বে, আমি আগেকার দিনের ক্যামেরাম্যানের মতো কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে রাখলে দেখব কী 'রে? তো, সেই খাতা দোকানের বেঞ্চে ফেলে উঠে গেছিলাম মনে পড়তে দৌড়ে গিয়ে দেখি, একটা ছেলে 'সে পাতা ওলটাচ্ছে সর্বনাশ! সরল-সাদা পাহাড়ি ছেলের হাতে শিক্ষিত-আঁতেল-যন্তরপিস বাঙালির আধুনিক কবিতা? ততক্ষণাত ঝঁপিয়ে পড়ে কেড়ে নিয়েছি আমি  পরিবেশ-দূষণের প্রচণ্ড বিরুদ্ধে!

শিলিগুড়ি থেকে যখন -পথে আসি, দীর্ঘদিনের বন্ধু রঞ্জিত দত্ত বলেছিল, "পাহাড়ে নেপালি, লেপচা বা ভুটিয়ারা যত সহজে বসতি করতে পারে, বাঙালি সেটা কখনই পারবে না আমরা সমতলের প্রাণী" ট্রেকারে 'সে পথের দুপাশে তাকিয়ে দত্তদার বাণীর সমর্থন পাচ্ছিলাম শুনশান রাস্তার বাঁদিক 'রে নেমে আসছেন যে মানুষটি, মাথায় সবুজ লতা-পাতার বোঝা- তাকে লাগছে দু'পাওলা চলন্ত বাগান এবং মনে রাখতে হবে, বর্ষা এখন বোল পালটে "দেন দেন গদি ঘেনে ধা ক্রান"! সমুদ্রগভীর এক থমথমে বাজনা উঠে আসছ এই ঋতুর সর্ব-গা থেকে আর বাকলে  বহু-চির দাগ নিয়ে নানা পোকা-মাকড়ের আশ্রয়, পুরনোস্য পুরনো... পাইন আমার প্রিয় পাইন! এমন গাঁজানো ঠাসা চুল তার মাথায়, বলতে লোভ হ’ল, “ভালুক-পাইন”! যেন মোটা লম্বা গুঁড়ির মাথায় চ’ড়ে ব’সে আছে পশম-র্তি বিয়ারশিশু।
নাহ, ফিরে গিয়ে এসব গল্প তোমার সামনে একবারও নয়! তা হ’লেই তো সেই জ্ঞান ফলাবে, লিখে ফ্যালো। আজ বরং রিহার্সালটা সেরে নিই, যখন তোমাকে সঙ্গে আনব (আনব তো জীবনে একবার নিশ্চয়ই), সেই ফাইনাল টেক-এর সময়ে কী কী দেখাব গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে, কোন কোন স্পটে একজন প্রকৃত দেবানন্দের .....স্যরি, একজন  সত্যিকারের গাইডের মতো দাঁড়িয়ে তোমাকে বোঝাবো নেওড়া ভ্যালি ফরেস্টের অন্ধি-সন্ধি।  

দুই
ভাবতে ভাবতে দুঘন্টায় লাভা। মনে হল, ঘুমা-ফিরা-কে সেই “ঘুম”ই বুঝি আমার চোখের সামনে। এত কুয়াশার ঘরবাড়ি চারদিকে, এবং দেখা যাচ্ছে, এখানকার অধিবাসীবৃন্দের নিঃশ্বাস নিতে অক্সিজেন লাগে না, মুখ আচমনে জল লাগে না, খেতেও দরকার পড়ে না চাওমিন বা স্যান্ডউইচ। শুধু এক ঢোঁক মজবুত আর টিঁকাও টাটকা কুয়াশা, ব্যাস!

বন্ধু রঞ্জিত দত্তেরই আত্মীয় গৌরাঙ্গ দাসের সঙ্গ করেছি শিলিগুড়িতে। সে এক জঙ্গল-পাগল। ভোরে উঠে হঠাৎ দূরের কোনও নদীর কাছে গিয়ে ব’সে থাকে।  আশ্চর্য সব ফুল আর পাখিতে ভর্তি তার ক্যামেরা। মিষ্টি বউ আর ততোধিক ফুটফুটে মেয়েকে ফেলে মাঝে -মাঝেই নিপাত্তা হ’য়ে যায় গভীর জঙ্গলে বাঘসুমারি করা দলের সঙ্গে। নদীয়ার  নিমাইকে একবারই সংসারের মায়া কাটাতে হয়েছিল সন্ন্যাসী হওয়ার কালে। কিন্তু দেখলাম,  আধুনিক গৌরাঙ্গের টেনাসিটি অনেক বেশি, সে ভরা সংসার জলাঞ্জলি দিয়ে দ্যাখ না দ্যাখ গৃহত্যাগী!

শেষ বিকেলের লাভা-তে হোটেলের গরমে ঢুকে প্রথমে মনে হয়েছিল, এখান থেকে আমাকে টেনে বের করে কার সাধ্যি! তারপর একটু ধাতস্থ হ’য়ে ভাবলাম, যতটা পয়সা উশুল করা যায়! বেরিয়ে পড়া গেল চাদরমুড়ি দিয়েশুনসান রেস্তোরাঁগুলোর দরজায় মেয়েদের বিষন্ন মুখ; কড়া কফি, ধোঁয়া-ওঠা মোমোর প্লেটে তারা অতিথিসেবা করতে চায়। কিন্তু আমি মানুষ যে মোটে একখানা! ক’টা দোকানে খাবারের অর্ডার দিই, বলো? ঘুরে বেড়াতে লাগলাম এদিক-সেদিক, হাওয়ায় শুকনো পাতার মতো। পথের কেউ কেউ জানিয়ে গেল, এখানে ওয়েদার এখন ভালো হবে না গো। তুমি লোলেগাঁও চ’লে যাও কাল সকালে উঠে। কেননা, লাভা-য় সূর্য বন্ধ, রিকোয়েস্ট করলেও উঠছে না। সাইট সিয়িং বাতিল। আবহাওয়া ভালো থাকল তো ট্রেক ক’রে রিশপও যেতে পারতে, এক ঘন্টায় পৌঁছে আবার এক ঘন্টায় ফিরে আসা। এবার সেখানে কতক্ষণ ত্থাকবে, তোমার ব্যাপার। হোটেলে ব’লে দিলে ওরা গাইডও এনে দেয় শ’দেড়েক টাকার মধ্যে। কিন্তু ঘটনা  হ’ল, না-দেখতে পাওয়াটাকেই যদি কেউ দেখতে পায়, তবে আর মুশকিল কোথায়? ধরো, এই যে তোমার সঙ্গে মনোমালিন্য ক’রে  আমি ফাঁচোট (পুরুলিয়ার ভাষা), অথচ সেই থেকে তোমার কথাই আমার কুল কুলকুণ্ডলিনীতে জেগে ব’সে আছে। আমার অটোনমাস নার্ভাস সিস্টেম ঝাউ গাছের ফাঁক দিয়ে ক্যামেরা ফেলে রেখেছে তোমার ওপরেই। তেমনি, আজ হয়তো লাভা আমাকে পাহাড়ের রেঞ্জ দেখাতে পারল না, কিন্তু আমি তার শূন্যতাকে ভ’রে থাকতে দেখলাম জল-মেশানো সাদা মতো একটা বস্তুতে যা আমাদের পাড়ার মানিক সকালবেলা বালতিতে নিয়ে ঘোরে। এবং তাকে যদি বলা যায়, মানিক, আজ এক সের দুধ বেশি দিতে পারবে? মানিকের মুখে তুমি কক্ষণও “না” শুনবে না।  সেরকম শিক্ষাই সে পায়নি। শুধু ব’লবে, এই একটু ঘুরে এসে দিচ্ছি। এবার, কোথায় সে ঘুরতে গেল, পশ্চিমবঙ্গের সব মানিকরা ভোরবেলা কোন জায়গা থেকে টুক ক’রে বেড়িয়ে আসে, আমার তো ধারণাই ছিলো না। যারা সিনিক, বলতেন, দ্যাখো গে যাও, মিউনিসিপ্যালিটির টাইম কলের সামনে মানিকের সাইকেল জিরোন খাচ্ছেমানুষের কতো না ভুল সন্দেহ! আসলে, মানিক-গোয়ালাদের গোডাউন হ’ল লাভা-র বাতাস-ভর্তি দুহাজার টন দুধ-কুয়াশা।

এবার তুমি যদি পাখি হও, যা আমি সত্যি ব’লে জানি, তবে এই কুয়াশা-পাথর বেয়ে ওঠো না, কে বারণ করছে। যদি তুমি গাছ, যে কথাটাও একফোঁটা বাড়িয়ে বলা নয়, তবে স্থায়ি ও নির্ভরযোগ্য এই মেঘের প্যাক মুখ-চোখে এক ঘন্টা লাগিয়ে রেখে তার পর হালকা গোধূলি-আলোর তুলো দিয়ে আস্তে ক’রে মুছে ফেলুন। থাকুন আরামে। বুনো হাতির কাঁধে চেপে যেমন নীলকন্ঠ পাখি ফোকোটিয়া রাস্তা পাড়ি দেয়! হঠাত দত্তদার কথার উত্তরটা মাথায় এল। প্রকৃতির রাজত্বে এসে, যেখানে নিসর্গই “দিল্লিশ্বরো জগদীশ্বরো বা”, তাকে আত্মায় বসিয়ে নিতে না পারলে টিঁকে থাকব কী ক’রে?  পাহাড়ি মানুষেরা তো পাহাড়েরই মিনিবুক চেহারা, অরণ্যের ঘুরে-ফিরে বেড়ানো সংস্করণ। ক’জন বাঙালি সেটা হ’তে পারে?
তিন

সন্ধে নেমে গেছে অনেকক্ষণ। শান্ত হ’য়ে এসেছে লাভা-র দুর্গসম বৌদ্ধমন্দির। হোটেলে ফিরে আসতে আসতে ভাবলাম, কেন আমি ট্যুরিস্ট হব? আমি তোমার গাইড হ’তে চেয়েছি যখন, শহরের লোক যাকে বলে হোস্টাইল ওয়েদার, আমাকে তার মধ্যেই তো থাকতে হবে। গাইড মানেই স্থানীয়। যখন কেউ আসে না এখানে, জীবন প্রতিকূল, তখন কি শিরায় শিরায় টের পাব না, দোকান সাজিয়ে শূন্য ব’সে থাকা মানুষগুলো ঠিক প্লাস্টিকের তারের গায়ে আঁকা রাজারানী? ঠোঁটে এন্তার-সে খৈনি গুঁজে বৃষ্টি-টুপির কানাত চিরে ছুরি-নজর চালানো ভাড়া গাড়ির হেল্পারকে চিনব না, যে গোটা দিনে ডেস্পারেটলি শুধু একটা ট্রিপ চাইছে? আর, আহা, নীল বর্ষাতি ঢাকা ওই স্কুল-কিশোরি! যে-ভঙ্গিতে সে বইয়ের ব্যাগে মুখ ডুবিয়ে হেঁটে গেল, সেটা তো টুকে নিয়েইছি তোমার-আমার নিজস্ব মুহূর্তের জন্যে!

হোটেলে আর ফিরতে ইচ্ছে ক’রল না। রাস্তার দুপাশে ফুলে সাজানো বাড়িঘর। তাদের রঙিন কাচ-বসানো বন্ধ দরজায় আমি মনে মনে টোকা দিতে লাগলাম, পেয়িং গেস্ট রাখবেন আমায়? হ্যাঁ হ্যাঁ, সারা জীবনের জন্যে। তারপর, আস্তে আস্তে যদি হাতে কিছু পয়সা জমাতে পারি, এবং সেটা দারু খেয়ে উড়িয়ে না দিই, তবে এখানেই আশ-পাশে একটা ছোট্ট মকান..... ।

Monday 18 August 2014

“আর ডি” এক্স

“আর ডি” এক্স 
হোয়াইট মার্বেল-এ তৈরি শীতল ও শক্ত --- অতীতের সমস্ত গথিক সৌধকে তুমি রাহুল দ্রাবিড় নামে ডাকতে পারো। যেমন আকাশ থেকে টাঙানো ঝাড়-লন্ঠন, যেমন মিউজিয়ামের দুধ-রঙ অন্তর্দেয়ালগুলো --- কিন্তু রাহুল কি ওই প্রাসাদে ব’সে চতুর্দশ হারেম তার মণিবসানো মণিবন্ধে নাচাতো? না। সে বরং রাজমহলটি বানানোর পর নিজের বুড়ো আঙুলকে টিকটিকির লেজ হয়ে যেতে দেখেছে, যা শরীর-বিচ্ছিন্ন হয়েও লাফাতে ওস্তাদ!

ওপরের স্তবক থেকে দুটো সত্যি পিছলে নেমে আসে। দুর্গের রাজার নাম ভারতীয় ক্রিকেট। আর রাহুলের পক্ষে উত্তরাধিকারী রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। সদ্য নিজের তৈরি কাঁচা রঙের গন্ধ-ওঠা বাড়ির কলিং বেলে যখন হাত রাখে রাজ-মিস্তিরি, তার বডি-ল্যাঙ্গোয়েজ দেখেছ! সিমেন্ট-খসখসে মোটা হাতের চিরুনি দিয়ে মাথার খাড়া কুন্তল সজুত করতে করতে সে বাকি ক’টা টাকার তাগাদায় এসেছে। তার গামছা-চেক লুঙ্গির আভিজাত্যের কাছে বাড়ির মালিকের তিনশো চব্বিশ টাকার হাওয়াই চপ্পলও থিন অ্যারারুট লাগে।

দুই
তাহলে ৯ই মার্চ দু’হাজার বারোতে সৌধ কি স্মৃতিসৌধে বদলে গেল! মোট্টেই না। আর. ডি. চিরকাল এক্স(অতীত)-ই ছিলেন। ব্যাট করতে নামার সময় ক্যামেরায় রাহুলের মুখখানা চোখে পড়েছে আশাকরি। টেস্টের মাঠে মনে হবে, বাবার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে প্যাড আপ করতে হয়েছে, ওয়ান ডে-র দিনে চলতি ধারণাঃ মা এইমাত্র দেহ রাখলেন, আর টি টোয়েন্টি? ছোট ছেলে আই.সি.ইউ.-তে! আধুনিকতম ক্রিকেটের “টিক টোয়েন্টি” সেবন ক’রেও রাহুল যে সুস্থ মাথায় অবসর নেওয়ার দিনক্ষণ মেনে সাংবাদিকদের সামনে বসে পড়েন, এই না কত! কাজেই রাহুল দ্রাবিড় হল কবর থেকে ওঠা এক ক্ল্যাসিকাল ভূতের নাম। অথবা, মহেঞ্জোদরোর বাঁহাতে কনুই ইস্তক বালা-পরা নগ্নিকার পুরুষ রেপ্লিকা। বিশ্ব ক্রিকেটে তিনি টাইম মেশিনে চেপে দুটো অধ্যায় পেছন থেকে লাফিয়ে এসে বসেছেন। এখন ব্যাটে-বলে ধোনি-যুবরাজ-পাঠান যেন ইন্দ্রিয়াসক্ত সৌরঝড়ের যুগ। এর আগে ছিল পতৌদি-দুরানি-বিশ্বনাথের “রোম্যান্টিক এরা”। কিন্তু শুরুতে “বল পড়ে, ব্যাট নড়ে কি নড়ে না”-র দমচাপা সুগন্ধে যে ফার্স্ট স্লিপের বাতাস ভারি হয়ে থাকে, তার জন্যে আমরা প্রণাম করলাম জয়সিমা ও গাভাসকার ও রাহুল দ্রাবিড়কে। এরা সমসাময়িক!

এমন স্লান্টিং ব্যাট, যে সামনের পায়ে ঝুঁকে খেললেও বল পিচে এক ড্রপ খেয়ে উইকেটকিপারের হাতে চলে যায়। দেখে আমাদের কী কুলকুলি! শুধু খেলা কেন হবে, জীবনই যেন অনন্ত। টার্গেট আছে, সময়সীমা নেই। বিবাহের সংজ্ঞা হল রাহুল দ্রাবিড় ক্রিজে গেছেন। সন্তানের জন্ম হল রান...বাট হোয়েন উইলিট টেইক প্লেইস! শুধু একের পর এক পুত্রকন্যাহীন ডেলিভারির কোলাভরি-ডি চলছে। আহা, তাড়াহুড়ো ক’রো না। আগে বাসন-ধোয়া, তরকারি-কাটা, মাছের আঁশ ছাড়ানো...তারপর তো উনুনে চাপাবো একটা জোরে পুশ, গ্যাপ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টাকে। হয়তো ছত্রিশটি বন্ধ্যা-বল শেষে স্কোয়্যার লেগ দিয়ে প্রথম সিঙ্গলস পরিবেশন, তারও ছ’বল পরে থার্ডম্যানে আর এক রান রচনা।

সত্যের যতটা সম্ভব কাছাকাছি ছিলেন তিনি। এবং ততদিনে সত্য অবসোলিট হয়ে গেছে। অথচ মুশকিল, রিটায়ার করার পরেও বেঁচে থাকার মতো, বুড়ো চুলের খুব পুরনো কোনও মানুষ রোব্বারের বাজারে হঠাত প্রকাশিত হওয়ার মতো, সত্যের স্লিপ-ডিস্ক ছায়াটা আমাদের টেনশান দিতেই থাকে। এখানে একখানি হাসি পরিবেশন করব। স্কুলবেলায় একটি মেয়ের জন্যে (ছেলে হলে “একটা” লিখতাম...দ্রাবিড় সভ্যতা) আমার হৃদয় কিছু গড়বেতা-কেশপুর করেছিল। গ্রামের পুকুরজলে তাই নিয়ে চ্যাংবাজির হপ-স্টেপ-জাম্পে গুজব ছড়িয়েছিল কি! এইরকম ছোট বিপন্নতার মধ্যে মাঝে-মাঝেই সত্যচরণ পালকে দেখতে পেতাম--- মেয়েটির বাবা--- সাইকেলে গ্যাস আনতে যাচ্ছেন বা বিকেলে পাশের পাড়ায় তাস খেলতে। দেখামাত্র আমার মনে অবধারিত ফিসফিস শুরু হতঃ সত্য কখনও চাপা থাকে না... ওই দেখো, সত্য ঠিক বেরিয়ে পড়েছে!

তিন
এই পৃথিবীতে কেউ কি কাউকে ইন্টারেস্ট-ফ্রি লোন দেয়, ভগবান ছাড়া? এবং তোমার ঝুপ-ঝুপ করে ঘাম ঝরে চেন্নাইতে মাথা-বুক থেকে, শীতের হাওয়ায় কোলকুঁজো পিঠের ভেতর শনশনিয়ে ঢুকে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এবং যখন পৃথিবীর দ্রুততম আপেলটা তোমাকেই খেতে চেয়ে ঠোঁটের কান ঘেঁষে শিস কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন ক্রিকেট বোর্ড ক্যারাম খেলে, রেসের মাঠে বসে থাকে স্পনসর আর মিডিয়া মাল-টাল খেয়ে ঘুমিয়ে কাদা। কিন্তু তুমি পালটা মার দিয়ে বেরিয়ে যাও না তো! যেহেতু জেনেছ, প্রতি-আক্রমণ এক রকম পালিয়ে যাওয়াই...ছেষট্টি ফুট পিচ রাস্তায় গড়াতে গড়াতে, মহাত্মার চেয়েও গায়ে বেশি কালশিটে-মার নিয়ে, বস, তুমি বুদ্ধপুত্র --- “কালা কানুন”, “সাদা কানুন”, সব জ্বলাকে রাখ করে দাও।

ব্যাটিংসত্য তোমাকে যে সুদহীন ঋণ দিয়েছিল, তারই “বলবুতেঁ পর” চালিয়ে গেলে, হে উদাসী! আমাদের কোন কাকভোরে জীবিকা খুঁজতে বেরিয়ে যাওয়া জীবনে, আমাদের সেলসম্যান নসিবে দ্রাবিড় রয়েছে। ছুটে বাস ধরা, ঝুঁকি নিয়ে পেরিয়ে যাওয়া রেললাইনের ওপরেই বস্তির রেডিয়োয় রাহুল ৩৭ বা ৪৫ নট আউট। “ও-মাল যখন একবার সেট হয়ে গেছে...” ব’লে আমরা ব্রাশ মুখে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। হিস্টিরিয়া রুগির দাঁতকপাটি আর দ্রাবিড়ের ডিফেন্স, খোলো দেখি তুমি কতবড়ো পোস্তোর বড়া!

দর্জির কাঁচি দিয়ে সাঁই করে টেরিকটন দুভাগে কেটে ফেলা--- দ্রাবিড়ের কভার ড্রাইভ। আর আহা, ওই আছে-কি-নেই-কোমর মোচড়ানো কৌণিক পুল-এর আবেগ, লজ্জায় লিপস্টিক-লাল “ভাবতেই পারিনি” ছক্কাগুলো। যেভাবে টি টোয়েন্টির নাইট ক্লাবে সব ক’টা বাউন্সারকে নামালেন পায়ের কাছে, তাতে মনে হবেই, ক্ল্যাসিক ছাড়া এ-জীবনে অন্য কিছুর ধোঁয়া ছাড়েননি, এবং গানওনি রবীন্দ্র বাদে অন্য কাউকে --- “যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্ব-রানে”।

তোমার জন্যেই ছিল আমাদের লম্বা ঘাসে কিশোর-পা ডুবিয়ে বাউন্ডারিতে দাঁড়ানো, পেছনে পুকুর। দুপুরের ঝামা রোদে যখন ভুরু গলে গিয়ে নিজের ঠোঁটটাকে সামুদ্রিক ঝিনুক করে তুলেছে, একটা ছিটকে আসা ক্যাচের সাধনা তোমার জন্যেই, হে রাহুল। দেরিতে ভাঙা ইনস্যুইংগার ভয়ে ভয়ে ফ্রন্টফুটে যাওয়া গরীব ছেলের অরক্ষিত পায়ে পড়ে তাকে দোলের বেলুনের মতো ফাটিয়ে দিত আর সেই স্বেচ্ছা-রক্তদান শিবিরে তোমারই মুখ ভাসিয়ে রাখতাম মোরা সকলে।

টেকনিক্যালি বলতে গেলে রাহুল মানে সতর্ক আর দ্রাবিড় সাহসী ( আমার ব্যক্তিগত ডিকশনারির প্রথম পাতায় পাবেন। যেমন বীরেন্দ্র ছিল “চলাও বল্লা” আর সহবাগ “ভাবতে ব’য়ে গেছে”)। এখন ডাকাবুকো লোক কি সাবধান হয়, প্রশ্নটা সেমিনারের বিষয় হতে পারে। এবং এই যে কন্ট্রাডিকশান ইন টার্মস, ইহার কারণেই রাহুলের চোখ-মুখ সদা-ঘোলাটে। যেহেতু আত্মগোপনের দু-নম্বর নামও রাহুল দ্রাবিড়।

স্বপ্নে আমাকে অনেকবার তার ইন্টারভিউ নিতে হয়েছে। সব সময়েই কিছু না ক’য়ে সামনে দিয়ে সাদা ব্যাট হাতে হেঁটে চলে যেত --- সালভাদোর দালি। একবার শুধু একটা প্যারা দিয়ে বলে, ঘুম থেকে উঠেই লিখে ফেলিস কিন্তুঃ

“আমার কাছে যে-কোনও খোলা মাঠই ক্রিকেট। তার শিশির-শিবির ঘাসগুলো, সেখানে শুয়ে সামান্য ফ্রি হ্যান্ড, প্যাডের ফিতে বাঁধা --- সব কিছুই। আমার কাছে সারাদিন রোদে ঝামা-পোড়া হয়ে ফেরার পর মা’র ভার মুখটাই স্কোরবোর্ড, ভিন রাজ্যে ক্যাম্পে যাওয়ার সময় ওই চোখের ছলছলানি ছুঁয়ে ক্রিকেট ম্যাগাজিনের ছবিগুলো আরও বেশি রক্তমাংস। প্লেনে এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়ে যাওয়া ঘুমের মধ্যে মেঘের শরীরে লেগে থাকে আমার স্কোয়্যার কাট... আমার প্রেম, সন্তানের মুখ, সব ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভে আঁকা।"

এক মিনিট পজ দিলেন রাহুল।

"ক্রিকেট সাত অক্ষরের। হেভেন তার চেয়ে একটা কম....."

বোকা বোকা লম্বা (গল্প)

বোকা বোকা লম্বা

মা
শীতের সকাল। বারান্দায় গ্রিলের পাশে আমি চমৎকার রোদে ব’সে আছি। না না, রোদ্দুরটি সুন্দর তা বলিনি কিন্তু। চমৎকার আমার নাম, এ-গল্পও এক বেড়াল-ফ্যামিলির।
আজ মানুষের রোববার, কিন্তু বেড়ালের ক্যালেন্ডারে লেখা, “দেরিতে ব্রেকফাস্ট”। মনুষ্যজাতির মধ্যে যারা অফিসবাবু, ছুটির দিনে আটটার আগে তো বিছানা ছাড়েন না। আর সেই জন্যেই এখনও পর্যন্ত বিবিলের দেখা নেই, পাড়া টহল দিতে বেরিয়েছে। বাচ্চা মানুষ, স্যরি বেড়াল, খিদেও বেশি।
তবে শুধু বয়েসের দোষ দেব কেন, বিবিলের ফিগারটাও মাথায় রাখা দরকার। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কসরত করতে গেলেই তারা আমার কাছে এসে কমপ্লেন ঠোকেঃ তোমার ছেলেকে সামলাও। আমরা সব তিন কেজি বিভাগের কুস্তিগির, অথচ বিবিল সাড়ে পাঁচ কিলো চেহারা নিয়ে লড়তে আসছে। আমাদের ঘাড় মটকে যাবে না!
মনের এই হতাশায় বেচারা আরও বেশি মানুষ-ঘেঁষা হয়ে পড়েছে। আমাদের আস্তানা, মানে এই দত্তবাড়ির ছোট মেয়ে বুন্নি-র ল্যাপটপের দিকে সারাক্ষণ হাঁ ক’রে তাকিয়ে ব’সে থাকে। বুন্নি গেমস খেলতে খেলতে হয়তো জিগেস করল, “বল তো এবার কোন বাটনটা টিপতে হবে?” ওমনি সে উঠে যেতে গিয়ে অ্যাত্তোখানি পায়ের থাবায় ভুল বোতাম প্রেস ক’রে দেয়। বুন্নি হেসে ফেলে, “ তুই একইরকম থেকে গেলি, বোকা বোকা লম্বা, সংক্ষেপে বি বি এল, মানে...উঁ উঁ...আমার বিবিলসোনা।
.............
গল্প থামিয়ে চমৎকার উলটো দিকে ঘুরে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ল। তারপর পাঁচিলের ওপর দিয়ে এক দৌড়ে রান্নাঘরের সামনে। আজ এতো সকাল সকাল গ্যাস ওভেনে চায়ের জল চাপানোর শব্দ শোনা যায় কেন? এবার একটু পেছনে হেঁটে সে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায়। এটা বুন্নির ঘর। মেয়েটাও নেই বিছানায়। হয়তো কাল রাতে দোতলার স্টাডি রুমে আলো জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। দেয়াল-ঘড়িটা উল্টো দিকের দেয়ালে, দেখা যায় না। কিন্তু ঘন্টা পড়ছে। চমৎকার গুনতে লাগলঃ আউ, সাউ, চিন কিত, অন্তা, মিউ, পার...। হা ভগবান, সবে সাতটা বাজে! টোস্টের কয়েকটা পোড়া টুকরো, তিন-চারটে বিস্কুট, কিছুটা ছানা, ডিমের কুসুম একটুসফোঁটা --- এইমাত্র সকালের খোরাকের জন্যে আরও দেড়টি ঘন্টা চুপ ক’রে ব’সে থাকা পোষায়, বল তো!

ছেলে
আমার মা যেদিন মারা যায়, এ-পাড়ার সব মা-বেড়াল গোল হয়ে আমাকে ঘিরে ব’সে ছলছল চোখে মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি তাদের মধ্যে চমৎকারের কাছে গিয়ে ওর কোলে মাথাটা গুঁজে দিই। সেদিন থেকে চমৎকারই আমার মা, আর এই গল্পটাও আমরা মা-ছেলেতে মিলে-মিশে বলব।
যাই হোক, পাড়া ঘুরে দত্তবাড়ির পেছনের পাঁচিল টপকে নিমগাছের ডাল থেকে একলাফে নেমেই থতমত খেয়ে দেখি, ঠিক সামনে গৌরীশংকর দত্ত। কিন্তু আজ তার আমাকে তাড়া দেওয়ার মেজাজ নেই, জলের পাম্পের পাশে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে কী একটা খুঁজতে ব্যস্ত। পেরিয়ে যেতে যেতে শুনলাম, চেঁচিয়ে বলছেন, “আরিয়ান্তোসে ইকড়িমিং চাউতা”। না না, গৌরীকাকু বাংলাতেই বলেছেন কথাটা, কিন্তু আমরা বেড়ালরা তো আর বাংলা জানি না, বলি না, বা বুঝি না। অথচ আমরা বেড়ালরাই আবার পৃথিবীর সব ভাষাই জানি এবং বুঝি। আসলে বেড়ালের মস্তিষ্কের কোষে এমন এক অটোম্যাটিক অনুবাদ ব্যবস্থা রয়েছে যাতে যে কোনও ল্যাঙ্গুয়েজ বেড়ালের নিজস্ব ভাষা “মার্জারিক”-এ পালটে যায়। শুধু তাই নয়, মানুষ কোনও শব্দ উচ্চারণ করলেই তার মার্জারিক অনুবাদ মস্তিষ্ক থেকে স্পষ্ট উচ্চারণে আমাদের কানে পৌঁছোবে। ঠিক যেন মেট্রো রেলে ঘোষণা হচ্ছে, “অগলা স্টেশন গিরীশ পার্ক”। যাই হোক, “আরিয়ান্তোসে ইকড়িমিং চাউতা” মানে হল, কাগজটা তো এখানেও নেই।
রোববারের সাত-সকালে বাড়িসুদ্ধ লোক উঠে পড়ে কী খুঁজছে তাহলে? ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেব ভাবছি, আমার মা রান্নাঘরের জানলার নিচ থেকে ঠোঁট চাটতে চাটতে বেরিয়ে এল। এসেই যথারীতি বকুনি, “কোথায় চরতে গেছিলি, হতচ্ছাড়াটা? এখন বেলা দুটো পর্যন্ত খালি পেটে ঘুরে বেড়াও গে”। তারপর গলা নামিয়ে বলল, “ বুন্নি আর ওর বাবা কলকাতায় যাবে। মেয়েটার কী যেন পরীক্ষা আছে”।
---রবিবারে পরীক্ষা!
--- তাই তো বলল, “ইগুতিনো আঙরাসু চিয়াং ডলুমি”। কিন্তু বুন্নি “আডমিটিকার” খুঁজে পাচ্ছে না ব’লে হুলুস্থুল। সে আবার কী জিনিস রে!
আমিও তো জানি না। মনে হচ্ছে, শব্দটা গ্রীক বা ইতালিয়। মুশকিল হল, আমাদের ব্রেইন এখনও ততো উন্নত হয়নি ব’লে কেউ দুটো ভাষা মিশিয়ে কথা বললে শুধু প্রধান ভাষাটার অনুবাদই কানে পৌঁছোয়।
............
কিছু ক্ষণ চুপচাপ দুই থাবার মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে থাকল বিবিল। তারপর হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গ’লে উঠোনে লাফিয়ে পড়ে তীরবেগে ছুট। “আবার কোথায় আড্ডা মারতে চললি?” ব’লে তার পেছনে হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ল চমৎকারও।

মা
সরকারবাড়ির পুকুরে অর্ধেক জল, বাকি অর্ধেক ঢেকে গেছে কলমি-বেতো শাকে। সেখান থেকে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠলে লম্বা ঘাসভরা জমি, মুখ না তুলে হাঁটো যদি, নাকে সুড়সুড়ি খেয়ে হাঁচি আসতে বাধ্য। তারপর বাতাবিলেবু গাছ একটা, যেখানে সোমঋতাদের দুধেল গরু আব্বুলিশ বাঁধা থাকে। জগন্নাথ সরকার বারাসাতে বাড়ি ক’রে ফ্যামিলি সমেত উঠে যাওয়ার পর এই সবুজ মাঠের টুকরোটা পাড়ার বেড়ালদের আড্ডা বা সেমিনারের জায়গা। বিবিল সেখানে দাঁড়িয়ে বারবার তাকাচ্ছিল কীর্তনবাড়ির দিকে। মিনিট খানিক পরেই, ঠিক যা ভেবেছি, সে-বাড়ির গেট পেরিয়ে দিশা মেয়েটা এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে সুড়ুত করে কাঠটগর গাছের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।
দিশার পুরো নাম অনেকগুলো সিংঘে, নায়েকে, আর্থার, পেরেরা দিয়ে বানানো, তিংসা বগির ট্রেনের মতো (তিংসা মানে বারো)। ও আসলে শ্রীলংকার খ্রিস্টান বেড়াল, কলোম্বোর বিখ্যাত উকিল মেন্ডিস পেরেরার কাছে মানুষ হয়েছে। ওই বাড়িতেই দুবছর ভাড়া ছিলেন কীর্তনবাড়ির ডক্টর রামবিলাস কীর্তনিয়া। দেশে ফেরার সময় বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন।
কাঠটগর-বন পেরিয়ে জামরুল গাছের আড়াল দিয়ে দিশা খুব জোরে ছুটে এল মাঠটুকু। তারপর বিবিলের নজরে আসার ঠিক আগে থেমে গিয়ে হেলেদুলে হাঁটতে লাগল। মুখের আহ্লাদি ভাব লুকিয়ে চোখদুটো উদাসীন-মতো করে বলল, আবার কী হ’ল? ডাকছিলিস কেন!
---এই, “আডমিটিকার” মানে কী রে?
মেয়েটা তো হেসেই বাঁচে না। “ওটা অ্যাডমিট কার্ড, ওতে রোল নম্বর, ছবি, সব দেওয়া থাকে। না নিয়ে গেলে পরীক্ষার হলে ঢুকতেই দেবে না। আমাদের বাড়ির বন্দনাদিও ন’টা বেয়াল্লিশের ট্রেনে যাচ্ছে, ওর আবার বিধাননগর কলেজে সিট পড়েছে তো!
আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে রোদের হেলানো রশ্মি দেখতে পেলাম। মনে মনে অল্প একটু পরিমিতি ক’ষে নিয়ে বললাম, আর ঠিক আধ ঘন্টা বাকি। কিন্তু এখন আমাদের আর কী-ই বা করার আছে!
আছে অনেক কিছু। বুন্নিদির অ্যাডমিট কার্ড আমি গতকালই দেখেছি ওর হাতে। নিশ্চয়ই ওই ঘরের মধ্যে কোথাও....।
বিবিল যেন কুকুরের তাড়া খেয়েছে, শরীরটা এমন ছোট্ট করে ছুট দিল দত্তবাড়ির দিকে। দিশা চেঁচিয়ে বলল, “ঝামেলা মিটল কিনা বিকেলবেলা এসে জানিয়ে যাস”। তারপর আমার দিকে চোখ পড়তে থতমত খেয়ে ক্যাবলার মতো হাসল, “আপনিও আসবেন, কাকিমা”।
কিন্তু সেসব দেখার সময় নেই এখন। প্রাণপণ দৌড়ে বড়রাস্তা লাগোয়া কচুবাগানের কাছে ধরে ফেললাম বিবিলকে।
তোর কি মাথা খারাপ হল যে মানুষকে সাহায্য করতে ছুটছিস! ওরা এক্ষুনি বুঝতে পেরে যাবে আমরা বাংলা ভাষা জানি। তারপর বাকি জীবন কুকুর হয়ে কাটাতে পারবি তো?
একটা অ্যাডমিট কার্ড খুঁজে দিলাম, আর এতকিছু ঘটে গেল!
শোনো, তোমারই মতো বোকা একটি সারমেয় মানুষের কথা শুনে একবার শুধু আহ্লাদে লেজ নেড়ে ফেলেছিল। বাকিটা ইতিহাস। এখন কুকুরদের সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দিয়ে আবার ভোরের আলো ফুটতেই বাড়ির বুড়োবুড়িকে মর্নিং ওয়াকে নিয়ে ছুটতে হয়। তারপর সকালের খবরের কাগজ মুখে করে নিয়ে আসা থেকে বাজারের ব্যাগ বওয়া, দুপুরে বৌদি ঘুমোলে বাচ্চার নজরদারি, দুবেলা বাড়ির ছোটদের সঙ্গে ফুটবল প্র্যাক্টিস ---এসব তো আছেই। রেডিও-টিভিতে, সিনেমায়, এমনকি মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে পর্যন্ত খাটছে কুকুর, অথচ কোনও কুকুরের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির লিস্টিতে একটা নোকিয়া বা স্যামসাং বা এলজি-র চোদ্দশো টাকার সেট-ও খুঁজে পাওয়া যাবে? আর, সবচেয়ে দুঃখের কথা কী জানিস? পুলিশ-মিলিটারিতেও কুকুর গিজগিজ করছে। মানুষ নিজের কাজ করাচ্ছে কুকুরকে দিয়ে।
আবেগে চোখে জল এসে গেছিল। বিবিল পেছনের দরজা দিয়ে দত্তদের ঘরে ঢুকে তক্ষুনি বেরিয়ে এসে বলল, কেন, ওরা মোটা মাইনেও তো পায়? তাছাড়া কুকুর কতো বিশ্বাসী প্রাণী সেটা বল? পেট ভরা থাকলে রান্নাঘরে ঢুকে খাবারে মুখ দেবার কু-স্বভাবটা নেই।
শুনে মেজাজ এত গরম হয়ে গেল, বাঁ হাত তুলে ওর মাথায় এক থাবা বসালাম, “জিভ খসে পড়বে নিজের জাতের বদনাম করিস তো। আমাদের দেবতা বেড়াদাস বলেছেন, চুরিই হচ্ছে খাঁটি বেড়ালধর্ম। বুঝলি ইঁদুরটা!
আমার অতশত বুঝে-সুঝে কাজ-টাজ নেই। বুন্নিদি আমাকে ভালোবাসে। দিদি পরীক্ষা দিতে না পারলে খুব কষ্ট হবে, ব্যাস।
দেখলাম, বিবিল দত্তভিলার পেছন দিকটায় চলে গেল। তার মানে পেঁপে গাছ বেয়ে ছাদে উঠে স্টোররুমের ফোঁকর গলে দোতলায় ঢুকে তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবে। যে মানুষ ওকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই তাড়িয়ে দেয়, উনি চললেন তাদের উদ্ধার করতে। হুঁহ!

ছেলে
শুনেছি, এর আগে তিন দফায় আমার মোট পাঁচটা দাদা-দিদি হয়েছিল। মা তখন যে বাড়িতে, সেই হালদারবাবুরা আড়াল দিলে ওরা হয়তো শেয়ালের পেটে যেত না। তারপর থেকেই মা একটু মানুষ-বিরক্ত। যাহোক, অনেকদিন পরে স্টোররুমে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। এই ঘরই আমার জন্মস্থান কিনা! ওই তো সেই প্লাইউডের বাক্স যার মধ্যে খেলা করে আমার “বৈশব” (বেড়ালের শৈশব আর কি) কেটেছে। কিন্তু পুরনো খবরের কাগজ লাট করে রাখার জায়গাটা যেন কোথায়? বুন্নিদির খাটের ওপর বইপত্র আর খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে বসার ওভ্যেস। অ্যাডমিট কার্ড বইয়ের সঙ্গে উঠে গিয়ে থাকলে এতক্ষণে শেলফ ঘেঁটে খুঁজে পাওয়ার কথা। কিন্তু রাঁধুনি নিরুমাসি বা অন্য কেউ যদি পেপারের সঙ্গে তুলে ফেলে? কাগজের স্তূপ থেকে এক একটা করে কামড়ে নামিয়ে ফের মুখে তুলে ঝাঁকাতে লাগলাম। নাহ, কিচ্ছু নেই, শুধু ধুলোয় গা-মাথা ভরে গেল। হঠাৎ মনে হল, নতুন কাগজের ডাঁই হলে তো এত ধুলো জমার কথা নয়! দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছি, বুন্নিদির গলায় চাপা কান্নার আওয়াজ! ইস, মা মারা যাওয়ার পর আমাকে তুলোয় করে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছে যে, সেই দিদিটার জন্যে কিছুই করতে পারব না! ঠিক এমন সময় সিঁড়ির ঠিক নিচে গৌরীকাকুর সাইকেল আর গ্যাস সিলিন্ডারের মাঝখানটায় চোখে পড়ল, আরও কিছু খবরের কাগজ ভাঁজ করে সাজানো, আর তার প্রথমটা ধরে টান দিতেই নিচে থেকে বুন্নিদির ছবি বেরিয়ে এসেছে। অ্যাডমিট কার্ড মুখে করে ছুটতে যাচ্ছিলাম ও-ঘরে, মনে পড়ল মা-র সাবধান-বাণী! আমাদের ধর্মগ্রন্থ (পড়ব পড়ব করে আর পড়া হয়ে ওঠেনি) “বেড়াভাগবতে” নাকি লিখেছে, বেড়ালের বুদ্ধির কথা জানতে পারলে মানুষ তাদের রকেটে করে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেবে। আর সেখানে তাদের গায়ের লোম ঝরে গিয়ে চেহারাটা ঝাঁটার শলার মতো হয়ে উঠলে নিজেরাই নিজেদের তেলাপিয়া মাছের কাঁটা ভেবে খেয়ে ফেলবে তারা। আমি অ্যাডমিট কার্ডের ওপরে বসে পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগলাম। গৌরীকাকু এসে “সোবাতাং জিয়াও মুনি” (বাড়ি মাথায় করেছিস কেন?) বলে ঝুলঝাড়ু দিয়ে জোরসে পিঠের ওপর একখানা কষিয়ে দিল। কিন্তু ভয় পেলে সাহসের কাজ করা চলে না। আমি চিৎকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দেওয়ামাত্র শুনতে পাচ্ছি তরুকাকিমার গলা, “বেজিনা লুসিও। পিং সে কাই অরন তুদা।“ (তুমি পারবে না। গায়ে জল ঢেলে দিলে ও শায়েস্তা)। এই রে, পরীক্ষার প্রবেশপত্রও যে ভিজে সপসপে হয়ে যাবে! তরুকাকি এলে তেড়ে যাব কিনা ভাবছি, বুন্নিদি এতক্ষণে সিঁড়ির ঘরে ঢুকল, সব সময় একটা অবলা জীবের পেছনে লেগে আছো কেন! সকালে খেতে পায়নি বলে চিৎকার করছে সেটাও বুঝলে না?
“ইচিদং ত্রামে সোহা” (তোর জন্যেই এটা মাথায় উঠেছে) বলতে বলতে দুজনে বেরিয়ে গেলে আমি মেঝেয় পড়ে থাকা অ্যাডমিট কার্ডটার চারপাশে পাক খেতে লাগলাম। বুন্নিদি তক্ষুনি লাফিয়ে এসে কাগজটা তুলে নিয়ে একদম অবাক হয়ে গেছে। “কোথায় পেলি এটা? এত বুদ্ধি তোর! এবার তো সিসিল বলে ডাকতে হবে ওস্তাদকে, মানে চালাক-চালাক-লম্বা! আমার কিন্তু প্রথম থেকেই সন্দেহ হত বাংলা ভাষাটা তুই কব্জা করে ফেলেছিস...হ্যাঁ রে, হাঁ করে দেখছিস কী?

আমার মাথার অনুবাদ-যন্ত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। বুন্নিদির কথা শোনামাত্র বুঝে ফেলছি আমি। তার মানে মানুষই হোক, বা পশু-পাখি বা গাছপালা, ভালোবাসার ভাষা সবার বেলাতেই এক। একজনের মুখ ফুটলেই আরেকজন টের পেয়ে যাবে। এমনকি উচ্চারণ করারও দরকার নেই। যেমন বুন্নিদি এখন আমার গলায় সুড়সুড়ি দিতে দিতে মনে মনে বলছে, কিন্তু তুই ইংরিজি কী করে শিখলি, বিবিল? নিশ্চয়ই তোর সেই শ্রীলংকান বান্ধবীর কাছে!

ফুটবল

ফুটবল

ভারতের সঙ্গে ইউরোপিয় বা লাতিন আমেরিকান ফুটবলের তফাত কি, একজন জিগেস করেছিল। আমি এ-ব্যাপারটা বিশেষ বুঝি না।
--- ওদের ফুটবলগুলো কি আলাদা? অন্য রংয়ের, বা বেশি দামি? 
--- না না, তা নয়। 
--- হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি, ওদের ফুটবলারদের দাম বেশি!
--- আহ, সেকথা হচ্ছে না। ফুটবলারদের মানগত পার্থক্য কতটুকু বলে আপনার ধারণা?
--- খালি চোখে যতদূর মনে হয়, ওদের ক্ষেত্রে ওরা বল নিয়ে খেলে আর আমাদের বেলায় বলটা আমাদের নিয়ে....

লোলেগাঁও চলে যাও

লোলেগাঁও চলে যাও

কে বলল এ-কথা! মেঘের ঝুরি-নামানো আকাশ, না বৃষ্টি-ফোড়ন দেওয়া কুয়াশার রান্নাঘর? চারদিকে তাকিয়ে শুধু দেখতে পেলাম একটা ফিরোজা রঙের বাস, স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে জাবর কাটছে। তার পেটের ভেতর কচি সবুজ ঘাসের বদলে কয়েকটা পাহাড়ি ছেলেমেয়ে। 
সুতরাং লাভা থেকে পা উঠল বাসের পা-দানিতে আর সাতের বদলে ছয়, এক হাজার ফিট নামার জন্যে আরম্ভ চালু শুরু এক শান্ত ঘূর্ণিসফর।
লোলেগাঁও যাওয়ার রাস্তার শুরুয়াত যদি হয় আপনার বাড়ির সাজানো-গোছানো বসার ঘর, কিছু দূর যেতেই বোঝা যাবে সেই বিল্ডিংয়ে লোহা-লক্কড় ডাঁই-করা বড় একখানি স্টোর রুমও আছে। কাজেই আপনার “সেলাম ওয়ালেকুম” যদিও বা ফুরফুরে হয়, “খুদা হাফিজ”টির গায়ে ব্যথা থাকবে ভালো রকম।
কিন্তু যে-মুহূর্তে পথপ্রবেশ, তক্ষুনি একটা মায়াভ্রমনের মধ্যেও ঢুকে পড়লেন আপনি। অর্ধেক পা খাদে আর বাকি অর্ধেক মাটিতে রেখে জঙ্গলের প্রসারিত জিভের মতো এই রাস্তা। এবং আপনি ধীরগতিতে পার হয়ে যাচ্ছেন (রাষ্ট্রপতির কনভয়)....দুপাশে নানা ট্যাবলো --- বাদামি মাটির গা ভেঙে ঝোরাটা যেহেতু পাতাপল্লব ডালপালা ভিজিয়ে নেমে আসছে, শোঁ-শোঁ আর ঝমঝম মেশানো অপার্থিব তার গলার আওয়াজ। আবার ঠিক পাশে হলদে-সবুজ থেকে কালো-সবুজ --- ঝুলন্ত, হাতির কানের মতো পাহাড়-দেয়াল ঢেকে দেওয়া ফার্নের উপজাতি-গ্রাম। যেন এক দিগন্তজোড়া থিমপুজো।
তুমি আসবে বলে এখানে অনন্তকাল অপেক্ষা করছে সবাই ---এই পাখির ডানার মতো শ্যাওলার বিমর্ষ পালক বা নিঃশ্বাসচুপ ঝাউপাতারা। পৃথিবীর একটি প্রাণ আছে আর সেই ধুকধুকি এখানে ভিজে পাথরের গায়ে হাত রাখলে পাওয়া যাবে। নিচে তাকিয়ে...খুব ছোট্ট আমাদের সমাজ --- ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা, অবিশ্বাসের। প্রেমও কি ছিল না? ছিলই তো! তবে তার চেহারা এখন এম্পায়ার সার্কাসের দুহাজার দর্শকের মাঝখানে বাঘ আর রিং মাস্টার...গোটাটাই প্রেস্টিজ ইস্যু।

বাসের মধ্যে বাসঃ
ভিড় একটু কমতে চোখে পড়ে, বাসের প্রত্যেক জোড়া-সিট ফুলকাটা তারে ঘেরা এক একটা পাখির খাঁচা, আর সবকটা দাঁড়ে দুটি করে ময়না বা থ্রাশ বা দোয়েল বা ম্যাগপাই। অথবা সেই সব কচি-ঘাস যারা হয়তো কালিম্পংয়ের কলেজে পড়ে, তাদের জিনস-সোয়েটার, আর হলুদ গালে বেদানা ফুটে আছে। আহ্লাদিপনা দেখলে মনে হবে সব তরুণই উল্লাস মল্লিক আর মেয়েরা হাশিরাশি দেবী। কিন্তু বড় আশ্চর্য হল সে বাসের ড্রাইভার! হয়তো সত্তর তিনি তুষারবর্ণ মাথার চুলে, হলুদ গেঞ্জির নিচে তামাটে বড়সড় হাত মাঝে মাঝে শুধু স্টিয়ারিং থেকে সরে এসে মিউজিক পালটে দেয়ঃ “একদিন তেরি বাহোঁমেঁ” থেকে “গুমসুদা” থেকে “কভি আলভিদা না কহনা”! পাশে-পেছনে উর্দু-কবিতার কাপলেট-এর মতো (কাপ-প্লেটের মতোও বলতে পারো) ঘনিষ্ঠ যুগলদের নিয়ে তিনি এক পাখি-ডাকা পথ পার হচ্ছেন শান্ত নাবিকের প্রায়। হয়তো ইঊরোপ থেকে পালিয়ে প্রেমের সন্তটি কালিম্পং-লোলেগাঁও রুটে ড্রাইভারির ছলে ক’জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে আগলে রাখার ডিউটি দিচ্ছেন! মনের মধ্যে একটা ছড়া উড়ে এল। বলি?

ছিল আকাশে বিচ্ছেদ লেখা কাজ
এসো ওকে যত্ন করে মুছি
যত বড় হোক সৈন্যসমাজ
চোখে ছুঁড়ব জ্যোৎস্নার কুচি

দুজনের কথালাপ, চাউনির সুরা ---
থেকে খসে পড়ছে প্রেমের শিশুরা

শরণার্থী মুখগুলো বুকে আঁকড়ে নিন
আপনি ওদের দাদু ---ভ্যালেনটাইন

আমার লোমশ অ্যাসিস্ট্যান্টঃ
পাশের সিটে এক হেভি-ডিউটি ভদ্রলোক। একটু গলা-খাঁখারি দিলামঃ বাঙালি?
ভুরুদুটোকে পথনির্দেশের মতো করে পালটা ছাড়লেনঃ চিনলেন কী করে?
গোঁফ দেখে --- প্রায় মুখ ফসকে গেছিল আর কি!
তো সে ব্যক্তিটি হলেন ট্যুরিস্ট-ম্যানেজার। এই গিরি-শীর্ষের পরে যার সঙ্গে আর একবার গিরীশ পার্কের পাতালে দেখা হবে। বগলদাবা করে তুললেন তার মার্ক্সবাদী (শ্রেণীহীন) হোটেলে। রুমের দরজা খোলে, তবে কীভাবে বন্ধ হবে, না ভেবেই। মেঝেতে “পুরু কার্পেট”, তবু শব্দদুটোর মধ্যে “ধুলোর” বসিয়ে নিলে বর্ননা আরেকটু “অ্যাকুরেট” হয়।
কিন্তু এখন বারা বজকর চালিশ মিনট এবং আমার পেটের মধ্যে বারোশো চল্লিশটা ছুঁচো সাইট সিয়িংয়ে ব্যস্ত। খাবারের কথায় ম্যানেজার রামকৃষ্ণ-মুদ্রা দেখিয়ে দিলে নেওড়া ভ্যালির লেপার্ডের মতো বেরিয়ে লোকালয়ে পড়লাম, খানকতক রুটি শিকার না করলেই নয়!
দেখা গেল, লাভা-য় যা অমিল, একটুকরো ম্যাল রয়েছে লোলেগাঁওয়ের পাহাড়চুড়োতে। তাতে ট্যুরিস্টের সুবিধে হয়, কেন না প্লেইনের লোক মস্তিষ্কের রুকস্যাকে একখণ্ড “সমতল” বহন করেই ঘুরতে যায় তো!
আরও দেখা গেল, রোদ-ঝামরানো মাঠে চারটে কালো কাঠ-লম্বা লোক দাঁড়িয়ে, পিঠে সাদা কাপড়ের বিশাল পোঁটলা। “আমরা সেই মুর্শিদাবাদের করিমপুর থেকে আসছি। এখন চার-পাঁচ মাস এই পাহাড়ে ঘুরে বেড়াব, বেচব চাদর, শাল, বেডকভার, শাড়ি। এই ধরুন, হেঁটে হেঁটে বস্তির দিকে চলে যাই, তারপর রাত্তিরে থেকে গেলাম কোনও না কোনও বাড়িতে। নেপালিরা এত বিশ্বাসী মানুষ, এই শীতে নিজেরা বাইরে শুয়ে ঘরে বউ-বাচ্চার সঙ্গে শুতে দেয় অতিথিকে। কিন্তু যদি কোনও শয়তানি করেছ ---এ-পর্যন্ত এসে বক্তা আমার মুখপানে খুব সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকে। আরও ঘাবড়ে গেলাম যেই দেখি, ঘাসের ওপর পড়া আমার ছায়ার বেশ ঝাঁকড়া একটা লেজ গজিয়েছে। তাড়াতাড়ি পেছন ফিরে....অ, তাই বলো! আমাদের ভাঙাচোরা রিসর্টের ততোধিক হাঁফধরা সেপাই! তক্ষুনি মনে হল, তুমি থাকলে কী খুশিই না হতে চরকি-কে দেখে। না, এই কুকুরটার নাম নিশ্চয়ই চরকি নয়। কিন্তু তোমার খুব আদরের বন্ধুটি হঠাৎ মারা যাবার পর পৃথিবীর সব সারমেয়ই যে কীভাবে চরকি হয়ে গেল তোমার কাছে, ভাবলে আজও বিস্মিত ছলছলানি আসে আমার চোখে! তো, আমিও বড় এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে ঢালু ডানহাতি রাস্তা বেয়ে হাঁটা লাগালাম --- আজ এতেই দুজনের লাঞ্চ হয়ে যাবে।

পথের দুপাশে শুধু জনবিরল বাতাস। লাভা-র মতো এখনে রোদ-অনটন নেই, চলিষ্ণু মেঘের নিচে থোকা থোকা ফুটে আছে। আচ্ছা, ওই রহস্যময় ড্রাইভার তো প্রতিদিন তার বাসে করে লোলেগাঁওয়ের রোদ্দুর নিয়ে বিক্কিরি করতে পারে লাভা-য়, আর লাভা-র কুয়াশা লোলেগাঁওতে। তাতে বাড়তি দুটো পয়সার মুখ দেখতে পায় সে!
একটু এগিয়ে রাস্তার ডাইনে বন-দপ্তরের ট্যুরিস্ট বাংলো, পুড়ে খাক হয়ে আছে। কিছু দূরে গোর্খা হিল কাউন্সিলের ট্যুরিস্ট লজ। খুব লতা-পাতায় ছাওয়া সেই বনস্থলীতে পাখির চিল-চিৎকারে কান আহত হয়ে আসে। পেছনে তাকিয়ে দেখি, চরকি হাওয়া।

আবার সেই গোলচক বা ম্যালে ফিরছি। চরকি বছর পনেরোর একটা বাচ্চার আদর খেতে ব্যস্ত। আমাকে নজরে পড়তেই সে ছেলে দৌড়ে এসে অনেক কিছু বলতে লাগল, এটা না ভেবেই যে তার দেশোয়ালি নেপালির নাগাল আমি লাফিয়েও পাবো না। শুধু একটা শব্দসুতোর দুদিক ধরে ঝুলে রইলাম দুজনে ---হ্যাঙ্গিং ব্রিজ। হ্যাঁ, লোলেগাঁওয়ে এটা অন্যতম দেখার জিনিস বটে। কাজেই বৌদ্ধমন্দিরের পাশ দিয়ে বাঁদিকে কোমর মোচড়ালে সরু, গড়ানো উপ-পথ শুধুই নিচে যেন কোনও অন্যায়-যজ্ঞের দিকে টেনে নিয়ে চলল আমাদের, যার পুরোহিত ওই বাচ্চা ছেলেটা। এর মধ্যে সে দশবার বলেছে টাকার কথা, আমার শার্টের বুক-পকেট শুঁকতে চেয়েছে গোয়েন্দার মতো।
.....নামতে নামতে শেষে হঠাৎ পেয়ে গেলাম এক টুকরো ঘাস-চঞ্চল মাটি, মাকড়সার জাল ছিঁড়ে তাকালে দূরে ঝর্নার ওপর বৃদ্ধ রোগা সাঁকোটা দেখা যায়। তার সারা গায়ে চকখড়ির দাগের মতো রোদ্দুর, বোরাক্স-দানার আদলে জলবিন্দু। অবাক-ভয়ে তাকিয়ে থাকলাম......ভালুক-ডাকা জঙ্গলে এই সেতু একা, ধ্যানশান্ত যোগী।
না, ছুঁয়ো না তাকে....।

কত কথা আছে বাকি
গুম্ফার নিচের ধাপে একটা পার্ক, হাজার ফুল আর অসংখ্য নির্জন বসার জায়গা। গেট ঠেলে ঢুকছি যখন, আমার পেছনে এক স্থানীয় মহিলা। পার্কের কানাত যেখানে ঝাউ-সাজানো খাদের মুখাপেক্ষী, রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বাচ্চা ছেলেটার কথা ভাবছিলাম, “গাইড-ফি”র পুরো একশো টাকাতেই সে নাকি মিষ্টি কিনবে! পলকা একটা দেশলাই-কাঠি মনে হয়েছে আমার ওকে। সেই কাঠি জ্বালিয়ে আপনি পড়ার টেবিলে মোমবাতি ধরাবেন, না পেট্রোল-ভেজা সরকারি অফিসের কাঠের দেয়ালে ছুঁড়ে মারবেন, আপনার ব্যাপার।
পেছনে পায়ের শব্দে মুখ ফেরালাম, সেই মহিলাই। আমার সমরেখায় কিছুটা দূরত্বে এসে দাঁড়ালেন যেন আরেক ট্যুরিস্ট, চোখ সামনের খাদে। ওমনি দুজনের মাঝখানে চরকি আবির্ভূত --- আলাপ করিয়ে দিই, ইনি কলকাতা থেকে আজই এসেছেন, সঙ্গে কেউ নেই বলে বাধ্য হয়ে আমাকেই হেল্প করতে হচ্ছে, নাম হল....
“একা এসেছেন?” ভদ্রমহিলা আমার দিকে অর্ধেক ঘুরলেন।
বাড়ি ছাড়া অবধি প্রশ্নটা এই নিয়ে ছশো তেত্রিশ বার। মনে পড়ল, সিলসিলা-য় অমিতাভ বচ্চন। যেখানেই যায়, গুরুদোয়ারাতেও, সবাই বলে, বউ আনোনি? যদিও আমার বিষণ্ণতার মাপ ওই লোকটার চেয়ে মিনিমাম ছ’ইঞ্চি কম, তবে এটুকু বোঝা গেল হিন্দি সিনেমায় যতরকম শিক্ষা, তার কিচ্ছুটি অবহেলা করতে নেই।
“হ্যাঁ। আপনি বুঝি এখানকারই?”
পেছনে মূল রাস্তার ওপর নীল প্লাস্টিক টাঙানো বাড়িটার দিকে ফিরে তাকালেন।
“ওই যে আমার দোকান। ম্যাগি, চা, ওমলেট, সব পাওয়া যায়। এই রেস্টুরেন্ট চালিয়েই তো দুই মেয়ের বিয়ে দিলাম। ছেলেটা এখনও স্কুলে।“
“ও আচ্ছা। হাজব্যান্ড কী করেন?”
চুপ করে গেলেন ভদ্রমহিলা। সন্ধে নেমে আসছে তার মুখ সাক্ষী রেখে, যে মুখের কাঁচা-হলুদ চামড়ায় অনেক মেচেতার ঘরবাড়ি। তেল-চকচকে ঠাসা চুল মাথায়, ফুল-পাতা আঁকা একটা সিন্থেটিক শাড়ি পরা। কিন্তু গাছভর্তি সবুজ পাতার মধ্যে একটা বাদামি পাতার আসন্ন মৃত্যুর মতো ক্লান্তি তার মন খারাপ করে দিচ্ছে বারবার।
চলো চলো, আর গল্প শুনে কাজ নেই, চরকি আমার পায়ে ঢুঁসোতে শুরু করে, তাছাড়া আমার কেমন বিস্কুট-খিদে পাচ্ছে।
মহিলা একটু হেসে মদ খাওয়ার ভঙ্গি করলেনঃ
“এতেই ব্যস্ত, কাজ করবে কখন! তিরিশ বছর একই রুটিন দেখে আসছি। আপত্তি করলেই অশান্তি, গায়ে হাত তুলবে...। তবে মেয়েরা আমাকে বোঝে।“
ভদ্রমহিলা ঘুরে ফেরার রাস্তা ধরলেন।
“আপনাদের ঘরের মেয়েদের দেখি তো। খুব হিংসে হয়, জানেন! অনেক আদরে রাখেন ওদের আপনারা”।
হালকা সন্ধেকাল, পার্কের গেট ঠেলে বেরিয়ে এলেন, পেছন-পেছন আমি। আমার বাঙালিমুখ...ভারতীয়মুখ...পুরুষমুখের রেখাগুলোর ঢেকে তার ওপরে এসে বসেছো অন্ধকার। তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।

আহত-অনাহত
আমি ইজিচেয়ারে আসীন, সামনে দুই বাধ্য ছাত্র-ছাত্রী হয়ে ঝুঁকে সময় আর প্রকৃতি। না, আমার গায়ে পাড়-বসানো নাইটগাউন বা দাঁতে পাইপের শেষপ্রান্ত নেই, বাঁশঝোপের পাশ থেকে তাকিয়ে নেই কোনও মিডল-শট ক্যামেরাও। যদিও, ডাবের পাতলা শাঁসের মতো এক সিনেম্যাটিক আলোয় মিস্টার আকাশ মিস কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরেছেন।
এই মুহূর্তের পৃথিবী মিডিয়ার হাতের বাইরে, হয়তো আমার সীমার বাইরে এই আমিও। কথা বলতে গেলে মুখ থেকে বাংলা ভাষাই ধ্বনিত হবে, না “অনাহত নাদ”! মনের নিচে জ্বলতে থাকা বাসনার গ্যাস ওভেন নিবে আসে...বুঝতে পারি অর্ধেক শতাব্দীর জীবন নষ্ট করেছি প্রকৃত কোনও কাজ ছাড়াই। পৃথিবী থেকে দুহাতে যে আলো-বাতাস-অন্ন-বৈভব কুড়িয়ে নিলাম, আমারও তো কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার থাকে!
“কিত্তিটা দেখেছেন আজকের বাসে? আপনার নিশ্চয়ই খুব ইয়ে হচ্ছিল!” হোটেল ম্যানেজার এসে ধপাশ করে সামনে বসে গেলেন। “নেপালি ছেলে-মেয়েগুলো কলকাতা তো ছেড়েই দিন মশাই, লাস ভেগাস-টেগাসও বগলের তলা দিয়ে পার করে দেবে!“
ম্যানেজারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ল, শিলিগুড়ি আসার দিন হলদিবাড়ি এক্সপ্রেসে আমার মুখোমুখি বসে থাকা মানুষটার কথা। তার ডান চোখটি ছিল মণিবিহীন, ওপরে-নিচে ক্রুশচিহ্নের মতো ফালি করা। বোঝা যায়, কারও ছুরি-শিল্পের ছোঁয়ায় কালো এক পুষ্পকোরকের চেহারা অর্জন করেছে ওই চোখ। তিনি বাঁ-দৃষ্টিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন, আর খুন হওয়া চোখের অন্ধকার থেকে ধারাবাহিক জল গড়িয়ে নেমে গালের অর্ধেক ভিজিয়ে দিচ্ছিল। সামনে বসে সারা দুপুর খাবার মুখে তুলতে পারিনি আমি। এর চেয়ে বাসের ভেতর পরষ্পরের বুকের মধ্যে উঠে যাওয়া তরুণ-তরুণী কি অনেক ভালো দৃশ্য রচনা করছে না?

শেষ দৃশ্যে সাসপেন্স
চলে যাব। চরকির সঙ্গে সম্পর্কটা আর আপনি-আজ্ঞেতে পড়ে নেই। আবার এসো, হোটেলের দরজায় দাঁড়িয়ে সে বলল।
তুইও যাস পারলে!
এবার সেই ফিরোজা-রঙের বাস ছেড়ে দেবেন আমাদের হলুদ-গেঞ্জির ভ্যালেনটাইন। রাস্তার পাশে কিছু মাঝবয়েসি মরদ মদ টেনে রোদ পোয়াতে বসেছে। আবার হাফ-প্যান্ট পরা কয়েকজন দোকানের বড় ড্রাম ভর্তি করছে বালতি বালতি জল টেনে। জীবন কিছুতেই তোমার-আমার একরকম হতে পারে না।
রাস্তা তো নয়, যেন একমুখ সৌমিত্রের হাসি, এখানে “উফ”, তো ওখানে “উই মা”! কিন্তু ভ্যালেনটাইন জানেন, কোন আলগা পাথরের নিচে শক্ত জমি আছে, আর কোন ঘাসমাটি আসলে তোমাকে ধসিয়ে দেওয়ার ক্যামোফ্লেজ! মাঝপথে বাস থামিয়ে তিনি চাষির হাত থেকে সংগ্রহ করেন এখনও-লাফাচ্ছে পালং, নীলচে গাজর এবং আমার একতিলও সন্দেহ থাকে না, পৃথিবীর বিশুদ্ধতম দেশি মাখন, এই অ্যাত্তোটা! “ভওরেঁ কি গুঞ্জন অ্যায় মেরে দিল...” চালিয়ে দিলেন, সে কি আমার জন্যেই ট্রিবিউট! এবং দেখলাম, বাসের অন্তর্নিহিত সত্য একই রয়ে গেছে, জ্যামিতির সন্নিহিত কোনের মতো সেই ছেলে-মেয়েরা ---যে কোনও মুহূর্তে গায়ে দুর্ঘটনা গড়িয়ে পড়লেও যাদের অসীম বাক্যরচনা থামবে না।
লাভা-য় পৌঁছনো মাত্র আবার সে বৃষ্টি-ঝড়ের শিরস্ত্রাণ পরিয়ে দিল। শুনতে পাই, ধস নেমে কালিম্পং-শিলিগুড়ি রুট বন্ধ বলে ওদিককার মানুষজন এই পথেই গোরুবাথান হয়ে সমতলে নামছে। টইটম্বুর একটা ট্রেকার আসে, জায়গা নেই, পেছনে দাঁড়িয়ে যেতে পারেন। অ্যাঁ, মানে পাদানিতে! একবার আকাশের দিকে তাকাই, একবার নিজের নিয়তির দিকে!
কন্ডাক্টারও আমার সঙ্গে ঝুলন্ত-দণ্ডায়মান। বারবার শুধু বলতে থাকে, “হাথ ছোড়িয়ে মত”। কিন্তু ভিজে হাতে ভিজে গাড়ির হাতল...ডিভোর্স হয়ে যেতে কতক্ষণ!
তখন ওই অবস্থাতেই সে গল্প শুরু করে দিল --- যে অরণ্য রেখে যাচ্ছি দুপাশে, সেখানে কী কী “চমৎকার” রয়েছে! আর ঘুরে-ফিরে থিতু হতে চায় সাপের কাহিনিতে। বুঝতে পারলাম, আমার মতোই সে এক মোহগ্রস্ত মানুষ। মোহ থেকেই ভয় আসে, ভালোবাসা থেকে তো আসে না।
--- আমার বাবার মুখে শুনেছি, ভোরবেলা উঠে একদিন একটা লোক জঙ্গলে---
--- বাঘ মারতে গেছে তো?
--- না না, ওই সকালবেলার কাজ সারতে....
--- বুঝেছি, ওটাই ট্রেকারদের ভাষায় “বাঘ মারা”
শুনে একচোট হেসে নেয় সে।
--- তো, বাঘ মারতে জল লাগবে। লোকটা দেখেশুনে গাছের গুঁড়ির ওপর পোজিশান নিয়ে বসেছে, জলের বোতল কাছেই, মাটিতে। একটু পরে দেখে, বোতল যেন দূরে অনেক। উঠে গিয়ে বোতল সামনে নিয়ে বসল। একটু পরে আবার একই ব্যাপার। তিন-চার বার ওঠা-উঠির পর গুঁড়ির ওপর বসতেই সেটা একদম উলটে ডিগবাজি! লোকটা তখন দেখে কি, ওরে সর্বনাশ, গাছ-টাছ নয়, ওটা আসলে একটা বিশাল...
“পাইথন” ---দুজনে কোরাসে বলে উঠি!
ততক্ষণে তীব্র হাওয়া উড়িয়ে নিয়েছে আমার কানদুটো, মাথার চুল পরচুলা হয়ে খসে গেছে। শীকর-ভোজন করতে করতে বৃষ্টির যদি কোনও অসুর থেকে থাকে, আমি বেলুনের মতো ফুলে উঠে হয়ে গেছি তাই। যে-অসুর ছবি আঁকে অজগরের ক্যানভাসে। হয়তো সাপটা একটা বুনো শুয়োরের বাচ্চা গিলে ছ’মাস ধরে পড়েছিল জঙ্গলের ওইখানে। ভাবো, ছত্রাকের গোল গোল দাগে ভরে গেছে শরীর, কতো পোকামাকড় শান্তির বাসা বানিয়েছিল পেটের নিচে বা কতো শামুক-দম্পতির হানিমুনের ঠিকানা হয়েছে ওই নিশ্চল দেহপ্রকাণ্ড। গায়ের ওপর লতিয়ে ওঠা গুল্মে, উদ্ভিন্ন চারাগাছে সে বনাঞ্চল ছাড়া আর কিছু নয় এখন। আবার একবার খিদে পেলে ওই প্রাগৈতিহাসিক চলতে থাকবে, ত্বক থেকে স্থানুতার সব ছবি মুছে ফেলে সে তখন “টারমিনেটার থ্রি”। একটা শিকার অর্জনের পর আবার প্রকৃতিকে সঁপে দেবে দেহ, জীবনশিল্প ফোটানোর জন্যে।

গোরুবাথানে নেমে মালবাজারের গাড়ি খুঁজতে লেগেছে সবাই। আমার তাড়া নেই, পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে বিকেলের ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম। ডামডিম-এর দিকে এগিয়ে ডানহাতি পথ ধরতেই ছোট-বড় সরকারি অফিস, কোর্ট আর উলটো দিক থেকে নীল পুলোভারে ক্লান্তমুখ কিশোরির ঝাঁক। ওদিকে কোথাও স্কুল থাকবে তবে। আমিও ফিরে যাচ্ছি যেখানকার মানুষ, সেখানে। কিন্তু কে বারবার বলতো এখানে পালিয়ে আসতে? আমি মাঝেমাঝেই কার গলা শুনতে পেতাম! মনে হল, শীত-ডাকা সন্ধেয় আবার সেই অচেনা স্বরের ঝুমঝুমি বাজছেঃ

ব্ল্যাঙ্ক হয়ে আছে বুক
নিঃঝুম....নিশ্চুপ...
অগ্নিশিখা আনো
ছাইমাখা অর্গানও

বুকে আকাশের পা
মন --- তুমি শেরপা
বাতাসে কলার ওড়াও
লোলেগাঁও চলে যাও