Monday 18 August 2014

সাক্ষাৎকারঃ বিনয় মজুমদার

সাক্ষাৎকারঃ বিনয় মজুমদার (জানুয়ারি, ১৯৯৪-এ “ঋতীয়া” পত্রিকায় ছাপা)

[১৯৯৩-র শীতে নেওয়া এই সাক্ষাৎকার। বিনয় সে-বছর কালীপুজোর ঠিক পরপর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসিত হয়ে ফেরেন শিমূলপুর, ঠাকুরনগরের বাড়িতে, কিন্তু অবস্থার খুব সামান্যই উন্নতি লক্ষ করা গিয়েছিল। দুবেলা খাবারের বন্দোবস্তো করা, ওষুধ খাওয়ানো বা স্নান করতে বলার লোক নেই। ফাঁকা বাড়িতে আবার বিনয় একা.....] 

“লিখে দিও এসব কথা বিনয় মজুমদার বললেন....”

---- তোমার নাম কী (চন্দন), কোথায় থাকো (দত্তপুকুরে), না তুমি কলকাতার সূর্য সেনের রাস্তায় একটা ছাপাখানাতে...আমার বই ছেপেছিলে মনে আছে (না, আমি চন্দন ভট্টাচার্য, দত্তপুকুর...) চুপ চুপ, চোখ বন্ধ করো, ঠোঁট বন্ধ, এবার ভাবো মোম লাগানো একটা কাপড়ে আলকাতরার কালি ফেলে ফেলে তুমি বই ছাপাও, এই ঘর, টেবিল, তক্তপোষ সব ভুলে যাও....মনে পড়ছে? (হুঁ) হ্যাঁ কিনা বলো (হ্যাঁ হ্যাঁ) বেশ, আবার তুমি চন্দন ওঝা ঠাকুরনগরে থাকো, থাকো কিনা? চোখ বন্ধ, ঠোঁট বন্ধ (হ্যাঁ, থাকি) আমার বাড়ির পাশে....কবিতা লেখো? (লিখি) একজন কবি চন্দন ওঝা, বিবাহিত, বাচ্চা আছে, তুমি বিয়ে করেছো? হ্যাঁ কিনা (হ্যাঁ), সন্তান আছে? (একটি) আবার তুমি থাকো দত্তপুকুরে....তুমিই তো কবিসেনা, কবিদের যুদ্ধ করতে বলেছিলে (না, আমি....) আঃ চুপ করো চোখ খুলছো কেন, কথা বলবে না, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে একদিন বক্তৃতা দিয়েছিলে....সেই দেবদারু গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বললে কবিদের শুধু কবি বলেই ডাকতে হবে, অন্য নাম নেই....বলেছিলে কিনা?

[যতোবার গিয়েছি, সন্ধের মুখেই তাকে ঘরে সহজে পাওয়া যায়; ময়লা গায়ে আর জামা-কাপড়ে, হাতপায়ের বড়ো নখে, সামান্য তক্তোপোষে জুতোসুদ্ধু বসে আছেন, পায়ের ওপর পা, ডানপায়ের পাতা অস্বাভাবিক জোরে নড়ছে। ঘরে ঢুকতেই শুকনো-নতুন গুয়ের মিলিত গন্ধ ফুসফুস চেপে ধরে, বিনয়ের স্নায়ু এই পরিবেশে আর কতোদিন জেগে থাকতে পারবে?]

--- তুমি বি এস সি পড়েছো? (হ্যাঁ), বেশ, অক্ষ পড়েছো? এই হলো উল্লম্ব অক্ষ, এই অনুভূমিক (বাতাসে আঙ্গুল দিয়ে এঁকে দেখান)। যদি অনুভূমিক অক্ষ বয়েস, তবে সে বেড়ে যাচ্ছে, শেষ নেই। এই টেবিলের এখানে শেষ আছে (কাঁপা হাতে টেবিলের প্রান্ত ঘষতে থাকেন) তারপর শেষ-ছাড়া বিস্তার (শূন্যে হাত চালিয়ে), তেমনি বয়েস তোমার যদি দশ বছর হয়, তবে তোমার তিরিশ বছর বয়েস হবে, তিরিশ হলে একশো পঞ্চান্ন হবে, তারপর তিন হাজার পাঁচ হয়ে যাবে, দু’লক্ষ তেত্রিশ হাজার বেয়াল্লিশ বছরও এভাবে বয়েস হয়ে যাবে কোনও বাধা নেই। শেষ-ছাড়া বিস্তার হবে যখন একবার জন্ম নিয়েছো পৃথিবীতে আর কোনও বাধা নেই....জন্ম, তারপর আবার জন্ম, আবার জন্ম...।

আমাদের এখানে এক পূজারী ঠাকুর আছেন তিনি বলেছেন তার বয়েস একশো তিরিশ বছর আর আমার চলছে একশো চোদ্দ।
যদি হাতি হাতির জন্ম দেয়, কাঁঠাল-ফল কাঁঠাল গাছের, ধান থেকে ধানের বাচ্চা হয়, তবে বয়েসও বয়েসের জন্ম দেবে।
আপনার শরীর এখন কেমন?
কোনও অসুবিধে নেই(যেন একটু অবাক), বেশ আছি।
আর্থিক বা কোনও সামাজিক অসুবিধে?
টাকাপয়সা নেই, দিয়ে যেতে পারো (বলেন, কিন্তু চোখে অস্বস্তি লেগে থাকে)
হাসপাতালে কেমন কাটছিলো দিনগুলো?
জানো, আমার ডাক্তাররা সব ছিলো বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাকা বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্জুলিকা বন্দ্যোপাধ্যায়(হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটান) উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়....উজ্জ্বল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পড়াতেন সাহিত্য-দর্শন, আচ্ছা বলতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিগত এতো বছরে সাহিত্য দর্শন শিল্পবিচার সম্বন্ধে এতো ছাত্র-ছাত্রীকে শিক্ষাদান করে ক’টি সাহিত্যিক তৈরি করতে পেরেছে? (উত্তরের অপেক্ষায় কিছুক্ষণ) একটাও না, কিস্যু না।

(মনে করিয়ে দিতে আবার আগের কথায় ফেরেন)
আমাকে কোথায় দেখেছিলে?(মেডিক্যাল কলেজ) মানসিক হাসপাতালে তো? (হ্যাঁ, মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল)...তো, এই মানসিক হাসপাতালের ডাক্তারদেরও চিকিৎসা হওয়া দরকার। বন্দ্যোপাধ্যায় মানে বন্দী যোগ উপাধ্যায়, ব্যকরণ কৌমুদী দেখে নিও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত...ওই সব বন্দী ডাক্তার, এদেরও মানসিক চিকিৎসার খুব প্রয়োজন....। যেমন যে জেলখানা নির্মাণ করলো সে জেলের মধ্যে কিছু লোকজন ছেড়ে দিয়ে বললো, তোমাদের কেউ হও অপরাধী, কেউ সান্ত্রী, কেউ জেলর...।

[ঘরে একটা জীর্ণ টেবিলে, যা কবি শূন্য থেকে তৈরি করেছেন, কয়েকটা মোমবাতি, দেশলাই, এক থালা জল। প্রথম দিন ঢোকামাত্র আদেশ হল, রাতের খাবার জোগাড়ের (দুটো পাঁউরুটি, এক কাপ চা), সন্ধে হতে নিজেই বললেন, আলো জ্বালানোর কথা, কিন্তু মোম বসানোর জায়গা কিছুতেই পছন্দ করে উঠতে পারছেন না --- “এই বিন্দুতে ঠিক এই বিন্দুতে...”, আর টেবিলের ওপর কাঁপা আঙ্গুল সরে সরে যাচ্ছে]

---সারাদিন কীভাবে কাটে আপনার?
আমি এই ঘরে খাটের ওপর....এক দিবস কতো ঘন্টায়? চব্বিশ। তার অর্ধেক বারো....আমি ধরো তেরো ঘন্টা....না না, চার বাদ দিলে কুড়ি ঘন্টা এই খাটে বসে থাকি নামি না বাইরে পৃথিবী খুব বিপজ্জনক....আমি অবশ্য সব কবিতা পাঠিয়ে দিয়েছি হাওড়া, শিয়ালদা, ডায়মন্ডহারবারে...সত্তর আশি একশো পঁয়ত্রিশটা কবিতা আমাকে গার্ড দিচ্ছে পৃথিবী খুব বিপজ্জনক....আমি বসে থাকি, মাথাটা দেখেছো আমার, সিংহের মতো, সিংহের যেমন কেশর থাকে (এলোমেলো চুলে হাত বোলান), দাড়িগোঁফে ঢাকা, তার ফাঁক দিয়ে সিংহের যেমন দুটো চোখ বের হয়, নাকের ফুটো, ঠোঁট....তুমি ছবি তুলতে পারবে এই ঘরের? (হ্যাঁ, আমার ক্যামেরা আছে), আচ্ছা থাক, ক্যামেরা আর কামরা একই জিনিস....আমার এই কামরায় বসে আছি (বিড়বিড় করতে থাকেন), তুমি বরং আমার একটা ছবি আঁকো, সিংহের মাথার ছবি।

[নিজের অঙ্কন-ক্ষমতার ওপর ভরসা না থাকায় পরে একদিন ক্যামেরা নিয়ে যাই, দেখেই বলে ওঠেন “ফোতো আপ্পারাত”। আরেকদিন নিয়ে যাই এককপি ছবি আর “যোগসূত্রে”র বিনয় মজুমদার সংখ্যা। দেখে এতো আনন্দ পান, ফেরত চাইতে পারি --- হয়তো এই আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি বিদেয় করে দেন আমাদের।]

---সুনীল, শক্তি.... এরা তো আপনার বন্ধু ছিলেন।
সুনীল নামে একজনই আছে, সুনীল গাভাসকার।
আমি বলছি গঙ্গোপাধ্যায় সুনীলের কথা। যোগাযোগ হয়?
সুনীল? বহু চিঠি দিয়েছে আমাকে। এইখানে (হাত দিয়ে খাটের ওপরটা চাপড়ান)।
সে কবে? এখন দেন কী?
সুনীল এখন....ইউ এন ই এস সি ও তার কবিতা ছাপায় ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশান....(পুরোটা বলেন, সুনীলের কবিতা ইউনেস্কো....
আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়?
চট্টোপাধ্যায় নয়, চক্রবর্তী, দ্বিচক্রযানে করে যে চিঠি বিলি করে বেড়ায়...হেমন্তের অরণ্যে...মানে, পোস্টম্যান....পোস্টমর্টেম....
ঘরে আমার নিজের লেখা কোনও কবিতার বই-ই দেখি না। কেন?
(পাঠকদের জানাই, কবির ঘরে একটুকরো কাগজও দেখিনি দীর্ঘদিন)
শোনো, কবিতা হচ্ছে আমার দেবী। কী? দেবী। তা দেবী আমার কাছে থাকতে চান না। কীভাবে যে উধাও হয়ে যান....!
আপনি দেবীকে দেখেছেন?
তুমি দেখেছো? (খুব বিরক্ত)
নাহ।
(আমাদের মুখোমুখি বসে নিজের পিঠে ডানহাতের তালু রাখেন)
আমার এই হাতটা দেখতে পাচ্ছো?
না
এই হাতটা যেদিন দেখতে পাবে....উদর মাংস হাড় ভেদ করে....সেদিন দেবীকেও....

[বিনয় মজুমদারকে আর কথা বলানো গেল না। দু-একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে “কী করে যে উধাও হয়ে যায়....প্রতিভাস প্রকাশিত কাব্যসমগ্র আটখানা এনেছিলাম....হাতে হাতে সবাইকে....দেবীকে অন্যের কাছে গচ্ছিত রেখেছি....” বলতে বলতে হঠাৎ গেয়ে ওঠেন আনন্দ-কান্না মেশানো সে এক আশ্চর্য আর্তনাদ; উদাত্ত গলা ভাঙ্গা ভাঙ্গা সুরের কাঠামোর ওপর টলতে থাকে]

আজি মধু সমীরণে
নিশীথে কুসুমবনে
তারে কি পড়েছে মনে
বকুলতলে?

বিদায় করেছো যারে নয়নজলে
এখন ফিরাবে তারে কীসের ছলে গো...

No comments:

Post a Comment