Sunday 24 August 2014

লাভা-র বয়

লাভা- বয়
এক
তুমি আমাকে বলেছ, লেখো, লেখোই না! সারাদিন এতো যে বকবক 'রে আমার কানের পোকা নড়িয়ে দাও, তা শুধু একাই কষ্ট পাবো কেন? দু-পাঁচশো লোক অন্তত বুঝুক কী গেরো আমার!

বৃষ্টি হচ্ছে, তবে আসি-যাই-মাইনে-পাই ধরণের দায়সারা বর্ষণ ধরো, তবলায়  "তেরেকেটেতাক তেরেকেটে" যেমন মেরেকেটে হালকা প্র্যাক্টিস একটা এদিক-সেদিক কাঠ-খোলা ঝোলানো ব্রিজের ওপর 'সে আছি নিচে বোল্ডারে জলধাক্কার রাগিনী শোনানো চেল নদী, স্থানের নাম গরুবাথান সেখানে কষ্ট-কষ্ট মুখ 'রে বসা আমি মনের কানে শুনলাম, তুমি এবার আঙুল তুলে শাসাচ্ছো --- লিখবে কিনা!

এখান থেকেই রাস্তা তার পিঠ সোজা 'রে দুপাশের পাইন-জঙ্গলকে ইন্সপায়ার 'রল, চল চল পাহাড়ে উঠি যেন রাখাল গরুর পাল 'য়ে যায় মাঠে এবং লাভা- উঠেও পথ যদি শেষ না হয়, কেউ কেউ সেই "চু" 'রে একই দমে কালিম্পং! তোমার সঙ্গে ঝগড়া 'রে অল্প কিছু কারেন্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম, ট্রেকার ছাড়বে বিশ সাল বাদ বিশ বোলে তো তিন ঘন্টা আগাম সিট বুকিং আমার পকেটে --- পঞ্চাশ টাকা পঞ্চাশ টাকা পঞ্চাশ টাকা  উত্তর কলকাতার বনেদি চালে একবার ভাড়ার প্রাইভেট কারের গায়ে হাত রাখতে গেছিলাম, কারেন্ট খেয়ে পালিয়েছি ভাড়া আটশো ওনলি, আপনার কথা-বার্তা ভালো লেগেছে 'লে একশো নামিয়ে দিলাম নিকুচি 'রেছে ভালো লাগার!

কত রকম দোকান গরুবাথানের ছোট্ট বাজার এলাকায়! তার কোনও একটিতে গিয়ে দাঁড়ালেই হাতে কার্ড ধরিয়ে দিচ্ছে --- লাভা যাবেন কি? এই মোবাইল নাম্বারে ফোন করলে আমারই ভাই, সস্তায় ভালো হো...  খাতার বদলে ছাতা নিয়ে ঘুরছিলাম, বৃষ্টিতে মাথা বাঁচানোর কাজে এর অভিজ্ঞতাও কিছু ফ্যালনা নয়! তাছাড়া, কখন শ্রাবণধারার সঙ্গে মিশে দু-একটা কবিতার লাইন 'রে পড়বে, আমি আগেকার দিনের ক্যামেরাম্যানের মতো কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে রাখলে দেখব কী 'রে? তো, সেই খাতা দোকানের বেঞ্চে ফেলে উঠে গেছিলাম মনে পড়তে দৌড়ে গিয়ে দেখি, একটা ছেলে 'সে পাতা ওলটাচ্ছে সর্বনাশ! সরল-সাদা পাহাড়ি ছেলের হাতে শিক্ষিত-আঁতেল-যন্তরপিস বাঙালির আধুনিক কবিতা? ততক্ষণাত ঝঁপিয়ে পড়ে কেড়ে নিয়েছি আমি  পরিবেশ-দূষণের প্রচণ্ড বিরুদ্ধে!

শিলিগুড়ি থেকে যখন -পথে আসি, দীর্ঘদিনের বন্ধু রঞ্জিত দত্ত বলেছিল, "পাহাড়ে নেপালি, লেপচা বা ভুটিয়ারা যত সহজে বসতি করতে পারে, বাঙালি সেটা কখনই পারবে না আমরা সমতলের প্রাণী" ট্রেকারে 'সে পথের দুপাশে তাকিয়ে দত্তদার বাণীর সমর্থন পাচ্ছিলাম শুনশান রাস্তার বাঁদিক 'রে নেমে আসছেন যে মানুষটি, মাথায় সবুজ লতা-পাতার বোঝা- তাকে লাগছে দু'পাওলা চলন্ত বাগান এবং মনে রাখতে হবে, বর্ষা এখন বোল পালটে "দেন দেন গদি ঘেনে ধা ক্রান"! সমুদ্রগভীর এক থমথমে বাজনা উঠে আসছ এই ঋতুর সর্ব-গা থেকে আর বাকলে  বহু-চির দাগ নিয়ে নানা পোকা-মাকড়ের আশ্রয়, পুরনোস্য পুরনো... পাইন আমার প্রিয় পাইন! এমন গাঁজানো ঠাসা চুল তার মাথায়, বলতে লোভ হ’ল, “ভালুক-পাইন”! যেন মোটা লম্বা গুঁড়ির মাথায় চ’ড়ে ব’সে আছে পশম-র্তি বিয়ারশিশু।
নাহ, ফিরে গিয়ে এসব গল্প তোমার সামনে একবারও নয়! তা হ’লেই তো সেই জ্ঞান ফলাবে, লিখে ফ্যালো। আজ বরং রিহার্সালটা সেরে নিই, যখন তোমাকে সঙ্গে আনব (আনব তো জীবনে একবার নিশ্চয়ই), সেই ফাইনাল টেক-এর সময়ে কী কী দেখাব গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে, কোন কোন স্পটে একজন প্রকৃত দেবানন্দের .....স্যরি, একজন  সত্যিকারের গাইডের মতো দাঁড়িয়ে তোমাকে বোঝাবো নেওড়া ভ্যালি ফরেস্টের অন্ধি-সন্ধি।  

দুই
ভাবতে ভাবতে দুঘন্টায় লাভা। মনে হল, ঘুমা-ফিরা-কে সেই “ঘুম”ই বুঝি আমার চোখের সামনে। এত কুয়াশার ঘরবাড়ি চারদিকে, এবং দেখা যাচ্ছে, এখানকার অধিবাসীবৃন্দের নিঃশ্বাস নিতে অক্সিজেন লাগে না, মুখ আচমনে জল লাগে না, খেতেও দরকার পড়ে না চাওমিন বা স্যান্ডউইচ। শুধু এক ঢোঁক মজবুত আর টিঁকাও টাটকা কুয়াশা, ব্যাস!

বন্ধু রঞ্জিত দত্তেরই আত্মীয় গৌরাঙ্গ দাসের সঙ্গ করেছি শিলিগুড়িতে। সে এক জঙ্গল-পাগল। ভোরে উঠে হঠাৎ দূরের কোনও নদীর কাছে গিয়ে ব’সে থাকে।  আশ্চর্য সব ফুল আর পাখিতে ভর্তি তার ক্যামেরা। মিষ্টি বউ আর ততোধিক ফুটফুটে মেয়েকে ফেলে মাঝে -মাঝেই নিপাত্তা হ’য়ে যায় গভীর জঙ্গলে বাঘসুমারি করা দলের সঙ্গে। নদীয়ার  নিমাইকে একবারই সংসারের মায়া কাটাতে হয়েছিল সন্ন্যাসী হওয়ার কালে। কিন্তু দেখলাম,  আধুনিক গৌরাঙ্গের টেনাসিটি অনেক বেশি, সে ভরা সংসার জলাঞ্জলি দিয়ে দ্যাখ না দ্যাখ গৃহত্যাগী!

শেষ বিকেলের লাভা-তে হোটেলের গরমে ঢুকে প্রথমে মনে হয়েছিল, এখান থেকে আমাকে টেনে বের করে কার সাধ্যি! তারপর একটু ধাতস্থ হ’য়ে ভাবলাম, যতটা পয়সা উশুল করা যায়! বেরিয়ে পড়া গেল চাদরমুড়ি দিয়েশুনসান রেস্তোরাঁগুলোর দরজায় মেয়েদের বিষন্ন মুখ; কড়া কফি, ধোঁয়া-ওঠা মোমোর প্লেটে তারা অতিথিসেবা করতে চায়। কিন্তু আমি মানুষ যে মোটে একখানা! ক’টা দোকানে খাবারের অর্ডার দিই, বলো? ঘুরে বেড়াতে লাগলাম এদিক-সেদিক, হাওয়ায় শুকনো পাতার মতো। পথের কেউ কেউ জানিয়ে গেল, এখানে ওয়েদার এখন ভালো হবে না গো। তুমি লোলেগাঁও চ’লে যাও কাল সকালে উঠে। কেননা, লাভা-য় সূর্য বন্ধ, রিকোয়েস্ট করলেও উঠছে না। সাইট সিয়িং বাতিল। আবহাওয়া ভালো থাকল তো ট্রেক ক’রে রিশপও যেতে পারতে, এক ঘন্টায় পৌঁছে আবার এক ঘন্টায় ফিরে আসা। এবার সেখানে কতক্ষণ ত্থাকবে, তোমার ব্যাপার। হোটেলে ব’লে দিলে ওরা গাইডও এনে দেয় শ’দেড়েক টাকার মধ্যে। কিন্তু ঘটনা  হ’ল, না-দেখতে পাওয়াটাকেই যদি কেউ দেখতে পায়, তবে আর মুশকিল কোথায়? ধরো, এই যে তোমার সঙ্গে মনোমালিন্য ক’রে  আমি ফাঁচোট (পুরুলিয়ার ভাষা), অথচ সেই থেকে তোমার কথাই আমার কুল কুলকুণ্ডলিনীতে জেগে ব’সে আছে। আমার অটোনমাস নার্ভাস সিস্টেম ঝাউ গাছের ফাঁক দিয়ে ক্যামেরা ফেলে রেখেছে তোমার ওপরেই। তেমনি, আজ হয়তো লাভা আমাকে পাহাড়ের রেঞ্জ দেখাতে পারল না, কিন্তু আমি তার শূন্যতাকে ভ’রে থাকতে দেখলাম জল-মেশানো সাদা মতো একটা বস্তুতে যা আমাদের পাড়ার মানিক সকালবেলা বালতিতে নিয়ে ঘোরে। এবং তাকে যদি বলা যায়, মানিক, আজ এক সের দুধ বেশি দিতে পারবে? মানিকের মুখে তুমি কক্ষণও “না” শুনবে না।  সেরকম শিক্ষাই সে পায়নি। শুধু ব’লবে, এই একটু ঘুরে এসে দিচ্ছি। এবার, কোথায় সে ঘুরতে গেল, পশ্চিমবঙ্গের সব মানিকরা ভোরবেলা কোন জায়গা থেকে টুক ক’রে বেড়িয়ে আসে, আমার তো ধারণাই ছিলো না। যারা সিনিক, বলতেন, দ্যাখো গে যাও, মিউনিসিপ্যালিটির টাইম কলের সামনে মানিকের সাইকেল জিরোন খাচ্ছেমানুষের কতো না ভুল সন্দেহ! আসলে, মানিক-গোয়ালাদের গোডাউন হ’ল লাভা-র বাতাস-ভর্তি দুহাজার টন দুধ-কুয়াশা।

এবার তুমি যদি পাখি হও, যা আমি সত্যি ব’লে জানি, তবে এই কুয়াশা-পাথর বেয়ে ওঠো না, কে বারণ করছে। যদি তুমি গাছ, যে কথাটাও একফোঁটা বাড়িয়ে বলা নয়, তবে স্থায়ি ও নির্ভরযোগ্য এই মেঘের প্যাক মুখ-চোখে এক ঘন্টা লাগিয়ে রেখে তার পর হালকা গোধূলি-আলোর তুলো দিয়ে আস্তে ক’রে মুছে ফেলুন। থাকুন আরামে। বুনো হাতির কাঁধে চেপে যেমন নীলকন্ঠ পাখি ফোকোটিয়া রাস্তা পাড়ি দেয়! হঠাত দত্তদার কথার উত্তরটা মাথায় এল। প্রকৃতির রাজত্বে এসে, যেখানে নিসর্গই “দিল্লিশ্বরো জগদীশ্বরো বা”, তাকে আত্মায় বসিয়ে নিতে না পারলে টিঁকে থাকব কী ক’রে?  পাহাড়ি মানুষেরা তো পাহাড়েরই মিনিবুক চেহারা, অরণ্যের ঘুরে-ফিরে বেড়ানো সংস্করণ। ক’জন বাঙালি সেটা হ’তে পারে?
তিন

সন্ধে নেমে গেছে অনেকক্ষণ। শান্ত হ’য়ে এসেছে লাভা-র দুর্গসম বৌদ্ধমন্দির। হোটেলে ফিরে আসতে আসতে ভাবলাম, কেন আমি ট্যুরিস্ট হব? আমি তোমার গাইড হ’তে চেয়েছি যখন, শহরের লোক যাকে বলে হোস্টাইল ওয়েদার, আমাকে তার মধ্যেই তো থাকতে হবে। গাইড মানেই স্থানীয়। যখন কেউ আসে না এখানে, জীবন প্রতিকূল, তখন কি শিরায় শিরায় টের পাব না, দোকান সাজিয়ে শূন্য ব’সে থাকা মানুষগুলো ঠিক প্লাস্টিকের তারের গায়ে আঁকা রাজারানী? ঠোঁটে এন্তার-সে খৈনি গুঁজে বৃষ্টি-টুপির কানাত চিরে ছুরি-নজর চালানো ভাড়া গাড়ির হেল্পারকে চিনব না, যে গোটা দিনে ডেস্পারেটলি শুধু একটা ট্রিপ চাইছে? আর, আহা, নীল বর্ষাতি ঢাকা ওই স্কুল-কিশোরি! যে-ভঙ্গিতে সে বইয়ের ব্যাগে মুখ ডুবিয়ে হেঁটে গেল, সেটা তো টুকে নিয়েইছি তোমার-আমার নিজস্ব মুহূর্তের জন্যে!

হোটেলে আর ফিরতে ইচ্ছে ক’রল না। রাস্তার দুপাশে ফুলে সাজানো বাড়িঘর। তাদের রঙিন কাচ-বসানো বন্ধ দরজায় আমি মনে মনে টোকা দিতে লাগলাম, পেয়িং গেস্ট রাখবেন আমায়? হ্যাঁ হ্যাঁ, সারা জীবনের জন্যে। তারপর, আস্তে আস্তে যদি হাতে কিছু পয়সা জমাতে পারি, এবং সেটা দারু খেয়ে উড়িয়ে না দিই, তবে এখানেই আশ-পাশে একটা ছোট্ট মকান..... ।

No comments:

Post a Comment