Monday 18 August 2014

লোলেগাঁও চলে যাও

লোলেগাঁও চলে যাও

কে বলল এ-কথা! মেঘের ঝুরি-নামানো আকাশ, না বৃষ্টি-ফোড়ন দেওয়া কুয়াশার রান্নাঘর? চারদিকে তাকিয়ে শুধু দেখতে পেলাম একটা ফিরোজা রঙের বাস, স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে জাবর কাটছে। তার পেটের ভেতর কচি সবুজ ঘাসের বদলে কয়েকটা পাহাড়ি ছেলেমেয়ে। 
সুতরাং লাভা থেকে পা উঠল বাসের পা-দানিতে আর সাতের বদলে ছয়, এক হাজার ফিট নামার জন্যে আরম্ভ চালু শুরু এক শান্ত ঘূর্ণিসফর।
লোলেগাঁও যাওয়ার রাস্তার শুরুয়াত যদি হয় আপনার বাড়ির সাজানো-গোছানো বসার ঘর, কিছু দূর যেতেই বোঝা যাবে সেই বিল্ডিংয়ে লোহা-লক্কড় ডাঁই-করা বড় একখানি স্টোর রুমও আছে। কাজেই আপনার “সেলাম ওয়ালেকুম” যদিও বা ফুরফুরে হয়, “খুদা হাফিজ”টির গায়ে ব্যথা থাকবে ভালো রকম।
কিন্তু যে-মুহূর্তে পথপ্রবেশ, তক্ষুনি একটা মায়াভ্রমনের মধ্যেও ঢুকে পড়লেন আপনি। অর্ধেক পা খাদে আর বাকি অর্ধেক মাটিতে রেখে জঙ্গলের প্রসারিত জিভের মতো এই রাস্তা। এবং আপনি ধীরগতিতে পার হয়ে যাচ্ছেন (রাষ্ট্রপতির কনভয়)....দুপাশে নানা ট্যাবলো --- বাদামি মাটির গা ভেঙে ঝোরাটা যেহেতু পাতাপল্লব ডালপালা ভিজিয়ে নেমে আসছে, শোঁ-শোঁ আর ঝমঝম মেশানো অপার্থিব তার গলার আওয়াজ। আবার ঠিক পাশে হলদে-সবুজ থেকে কালো-সবুজ --- ঝুলন্ত, হাতির কানের মতো পাহাড়-দেয়াল ঢেকে দেওয়া ফার্নের উপজাতি-গ্রাম। যেন এক দিগন্তজোড়া থিমপুজো।
তুমি আসবে বলে এখানে অনন্তকাল অপেক্ষা করছে সবাই ---এই পাখির ডানার মতো শ্যাওলার বিমর্ষ পালক বা নিঃশ্বাসচুপ ঝাউপাতারা। পৃথিবীর একটি প্রাণ আছে আর সেই ধুকধুকি এখানে ভিজে পাথরের গায়ে হাত রাখলে পাওয়া যাবে। নিচে তাকিয়ে...খুব ছোট্ট আমাদের সমাজ --- ঈর্ষা, প্রতিযোগিতা, অবিশ্বাসের। প্রেমও কি ছিল না? ছিলই তো! তবে তার চেহারা এখন এম্পায়ার সার্কাসের দুহাজার দর্শকের মাঝখানে বাঘ আর রিং মাস্টার...গোটাটাই প্রেস্টিজ ইস্যু।

বাসের মধ্যে বাসঃ
ভিড় একটু কমতে চোখে পড়ে, বাসের প্রত্যেক জোড়া-সিট ফুলকাটা তারে ঘেরা এক একটা পাখির খাঁচা, আর সবকটা দাঁড়ে দুটি করে ময়না বা থ্রাশ বা দোয়েল বা ম্যাগপাই। অথবা সেই সব কচি-ঘাস যারা হয়তো কালিম্পংয়ের কলেজে পড়ে, তাদের জিনস-সোয়েটার, আর হলুদ গালে বেদানা ফুটে আছে। আহ্লাদিপনা দেখলে মনে হবে সব তরুণই উল্লাস মল্লিক আর মেয়েরা হাশিরাশি দেবী। কিন্তু বড় আশ্চর্য হল সে বাসের ড্রাইভার! হয়তো সত্তর তিনি তুষারবর্ণ মাথার চুলে, হলুদ গেঞ্জির নিচে তামাটে বড়সড় হাত মাঝে মাঝে শুধু স্টিয়ারিং থেকে সরে এসে মিউজিক পালটে দেয়ঃ “একদিন তেরি বাহোঁমেঁ” থেকে “গুমসুদা” থেকে “কভি আলভিদা না কহনা”! পাশে-পেছনে উর্দু-কবিতার কাপলেট-এর মতো (কাপ-প্লেটের মতোও বলতে পারো) ঘনিষ্ঠ যুগলদের নিয়ে তিনি এক পাখি-ডাকা পথ পার হচ্ছেন শান্ত নাবিকের প্রায়। হয়তো ইঊরোপ থেকে পালিয়ে প্রেমের সন্তটি কালিম্পং-লোলেগাঁও রুটে ড্রাইভারির ছলে ক’জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে আগলে রাখার ডিউটি দিচ্ছেন! মনের মধ্যে একটা ছড়া উড়ে এল। বলি?

ছিল আকাশে বিচ্ছেদ লেখা কাজ
এসো ওকে যত্ন করে মুছি
যত বড় হোক সৈন্যসমাজ
চোখে ছুঁড়ব জ্যোৎস্নার কুচি

দুজনের কথালাপ, চাউনির সুরা ---
থেকে খসে পড়ছে প্রেমের শিশুরা

শরণার্থী মুখগুলো বুকে আঁকড়ে নিন
আপনি ওদের দাদু ---ভ্যালেনটাইন

আমার লোমশ অ্যাসিস্ট্যান্টঃ
পাশের সিটে এক হেভি-ডিউটি ভদ্রলোক। একটু গলা-খাঁখারি দিলামঃ বাঙালি?
ভুরুদুটোকে পথনির্দেশের মতো করে পালটা ছাড়লেনঃ চিনলেন কী করে?
গোঁফ দেখে --- প্রায় মুখ ফসকে গেছিল আর কি!
তো সে ব্যক্তিটি হলেন ট্যুরিস্ট-ম্যানেজার। এই গিরি-শীর্ষের পরে যার সঙ্গে আর একবার গিরীশ পার্কের পাতালে দেখা হবে। বগলদাবা করে তুললেন তার মার্ক্সবাদী (শ্রেণীহীন) হোটেলে। রুমের দরজা খোলে, তবে কীভাবে বন্ধ হবে, না ভেবেই। মেঝেতে “পুরু কার্পেট”, তবু শব্দদুটোর মধ্যে “ধুলোর” বসিয়ে নিলে বর্ননা আরেকটু “অ্যাকুরেট” হয়।
কিন্তু এখন বারা বজকর চালিশ মিনট এবং আমার পেটের মধ্যে বারোশো চল্লিশটা ছুঁচো সাইট সিয়িংয়ে ব্যস্ত। খাবারের কথায় ম্যানেজার রামকৃষ্ণ-মুদ্রা দেখিয়ে দিলে নেওড়া ভ্যালির লেপার্ডের মতো বেরিয়ে লোকালয়ে পড়লাম, খানকতক রুটি শিকার না করলেই নয়!
দেখা গেল, লাভা-য় যা অমিল, একটুকরো ম্যাল রয়েছে লোলেগাঁওয়ের পাহাড়চুড়োতে। তাতে ট্যুরিস্টের সুবিধে হয়, কেন না প্লেইনের লোক মস্তিষ্কের রুকস্যাকে একখণ্ড “সমতল” বহন করেই ঘুরতে যায় তো!
আরও দেখা গেল, রোদ-ঝামরানো মাঠে চারটে কালো কাঠ-লম্বা লোক দাঁড়িয়ে, পিঠে সাদা কাপড়ের বিশাল পোঁটলা। “আমরা সেই মুর্শিদাবাদের করিমপুর থেকে আসছি। এখন চার-পাঁচ মাস এই পাহাড়ে ঘুরে বেড়াব, বেচব চাদর, শাল, বেডকভার, শাড়ি। এই ধরুন, হেঁটে হেঁটে বস্তির দিকে চলে যাই, তারপর রাত্তিরে থেকে গেলাম কোনও না কোনও বাড়িতে। নেপালিরা এত বিশ্বাসী মানুষ, এই শীতে নিজেরা বাইরে শুয়ে ঘরে বউ-বাচ্চার সঙ্গে শুতে দেয় অতিথিকে। কিন্তু যদি কোনও শয়তানি করেছ ---এ-পর্যন্ত এসে বক্তা আমার মুখপানে খুব সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকে। আরও ঘাবড়ে গেলাম যেই দেখি, ঘাসের ওপর পড়া আমার ছায়ার বেশ ঝাঁকড়া একটা লেজ গজিয়েছে। তাড়াতাড়ি পেছন ফিরে....অ, তাই বলো! আমাদের ভাঙাচোরা রিসর্টের ততোধিক হাঁফধরা সেপাই! তক্ষুনি মনে হল, তুমি থাকলে কী খুশিই না হতে চরকি-কে দেখে। না, এই কুকুরটার নাম নিশ্চয়ই চরকি নয়। কিন্তু তোমার খুব আদরের বন্ধুটি হঠাৎ মারা যাবার পর পৃথিবীর সব সারমেয়ই যে কীভাবে চরকি হয়ে গেল তোমার কাছে, ভাবলে আজও বিস্মিত ছলছলানি আসে আমার চোখে! তো, আমিও বড় এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে ঢালু ডানহাতি রাস্তা বেয়ে হাঁটা লাগালাম --- আজ এতেই দুজনের লাঞ্চ হয়ে যাবে।

পথের দুপাশে শুধু জনবিরল বাতাস। লাভা-র মতো এখনে রোদ-অনটন নেই, চলিষ্ণু মেঘের নিচে থোকা থোকা ফুটে আছে। আচ্ছা, ওই রহস্যময় ড্রাইভার তো প্রতিদিন তার বাসে করে লোলেগাঁওয়ের রোদ্দুর নিয়ে বিক্কিরি করতে পারে লাভা-য়, আর লাভা-র কুয়াশা লোলেগাঁওতে। তাতে বাড়তি দুটো পয়সার মুখ দেখতে পায় সে!
একটু এগিয়ে রাস্তার ডাইনে বন-দপ্তরের ট্যুরিস্ট বাংলো, পুড়ে খাক হয়ে আছে। কিছু দূরে গোর্খা হিল কাউন্সিলের ট্যুরিস্ট লজ। খুব লতা-পাতায় ছাওয়া সেই বনস্থলীতে পাখির চিল-চিৎকারে কান আহত হয়ে আসে। পেছনে তাকিয়ে দেখি, চরকি হাওয়া।

আবার সেই গোলচক বা ম্যালে ফিরছি। চরকি বছর পনেরোর একটা বাচ্চার আদর খেতে ব্যস্ত। আমাকে নজরে পড়তেই সে ছেলে দৌড়ে এসে অনেক কিছু বলতে লাগল, এটা না ভেবেই যে তার দেশোয়ালি নেপালির নাগাল আমি লাফিয়েও পাবো না। শুধু একটা শব্দসুতোর দুদিক ধরে ঝুলে রইলাম দুজনে ---হ্যাঙ্গিং ব্রিজ। হ্যাঁ, লোলেগাঁওয়ে এটা অন্যতম দেখার জিনিস বটে। কাজেই বৌদ্ধমন্দিরের পাশ দিয়ে বাঁদিকে কোমর মোচড়ালে সরু, গড়ানো উপ-পথ শুধুই নিচে যেন কোনও অন্যায়-যজ্ঞের দিকে টেনে নিয়ে চলল আমাদের, যার পুরোহিত ওই বাচ্চা ছেলেটা। এর মধ্যে সে দশবার বলেছে টাকার কথা, আমার শার্টের বুক-পকেট শুঁকতে চেয়েছে গোয়েন্দার মতো।
.....নামতে নামতে শেষে হঠাৎ পেয়ে গেলাম এক টুকরো ঘাস-চঞ্চল মাটি, মাকড়সার জাল ছিঁড়ে তাকালে দূরে ঝর্নার ওপর বৃদ্ধ রোগা সাঁকোটা দেখা যায়। তার সারা গায়ে চকখড়ির দাগের মতো রোদ্দুর, বোরাক্স-দানার আদলে জলবিন্দু। অবাক-ভয়ে তাকিয়ে থাকলাম......ভালুক-ডাকা জঙ্গলে এই সেতু একা, ধ্যানশান্ত যোগী।
না, ছুঁয়ো না তাকে....।

কত কথা আছে বাকি
গুম্ফার নিচের ধাপে একটা পার্ক, হাজার ফুল আর অসংখ্য নির্জন বসার জায়গা। গেট ঠেলে ঢুকছি যখন, আমার পেছনে এক স্থানীয় মহিলা। পার্কের কানাত যেখানে ঝাউ-সাজানো খাদের মুখাপেক্ষী, রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বাচ্চা ছেলেটার কথা ভাবছিলাম, “গাইড-ফি”র পুরো একশো টাকাতেই সে নাকি মিষ্টি কিনবে! পলকা একটা দেশলাই-কাঠি মনে হয়েছে আমার ওকে। সেই কাঠি জ্বালিয়ে আপনি পড়ার টেবিলে মোমবাতি ধরাবেন, না পেট্রোল-ভেজা সরকারি অফিসের কাঠের দেয়ালে ছুঁড়ে মারবেন, আপনার ব্যাপার।
পেছনে পায়ের শব্দে মুখ ফেরালাম, সেই মহিলাই। আমার সমরেখায় কিছুটা দূরত্বে এসে দাঁড়ালেন যেন আরেক ট্যুরিস্ট, চোখ সামনের খাদে। ওমনি দুজনের মাঝখানে চরকি আবির্ভূত --- আলাপ করিয়ে দিই, ইনি কলকাতা থেকে আজই এসেছেন, সঙ্গে কেউ নেই বলে বাধ্য হয়ে আমাকেই হেল্প করতে হচ্ছে, নাম হল....
“একা এসেছেন?” ভদ্রমহিলা আমার দিকে অর্ধেক ঘুরলেন।
বাড়ি ছাড়া অবধি প্রশ্নটা এই নিয়ে ছশো তেত্রিশ বার। মনে পড়ল, সিলসিলা-য় অমিতাভ বচ্চন। যেখানেই যায়, গুরুদোয়ারাতেও, সবাই বলে, বউ আনোনি? যদিও আমার বিষণ্ণতার মাপ ওই লোকটার চেয়ে মিনিমাম ছ’ইঞ্চি কম, তবে এটুকু বোঝা গেল হিন্দি সিনেমায় যতরকম শিক্ষা, তার কিচ্ছুটি অবহেলা করতে নেই।
“হ্যাঁ। আপনি বুঝি এখানকারই?”
পেছনে মূল রাস্তার ওপর নীল প্লাস্টিক টাঙানো বাড়িটার দিকে ফিরে তাকালেন।
“ওই যে আমার দোকান। ম্যাগি, চা, ওমলেট, সব পাওয়া যায়। এই রেস্টুরেন্ট চালিয়েই তো দুই মেয়ের বিয়ে দিলাম। ছেলেটা এখনও স্কুলে।“
“ও আচ্ছা। হাজব্যান্ড কী করেন?”
চুপ করে গেলেন ভদ্রমহিলা। সন্ধে নেমে আসছে তার মুখ সাক্ষী রেখে, যে মুখের কাঁচা-হলুদ চামড়ায় অনেক মেচেতার ঘরবাড়ি। তেল-চকচকে ঠাসা চুল মাথায়, ফুল-পাতা আঁকা একটা সিন্থেটিক শাড়ি পরা। কিন্তু গাছভর্তি সবুজ পাতার মধ্যে একটা বাদামি পাতার আসন্ন মৃত্যুর মতো ক্লান্তি তার মন খারাপ করে দিচ্ছে বারবার।
চলো চলো, আর গল্প শুনে কাজ নেই, চরকি আমার পায়ে ঢুঁসোতে শুরু করে, তাছাড়া আমার কেমন বিস্কুট-খিদে পাচ্ছে।
মহিলা একটু হেসে মদ খাওয়ার ভঙ্গি করলেনঃ
“এতেই ব্যস্ত, কাজ করবে কখন! তিরিশ বছর একই রুটিন দেখে আসছি। আপত্তি করলেই অশান্তি, গায়ে হাত তুলবে...। তবে মেয়েরা আমাকে বোঝে।“
ভদ্রমহিলা ঘুরে ফেরার রাস্তা ধরলেন।
“আপনাদের ঘরের মেয়েদের দেখি তো। খুব হিংসে হয়, জানেন! অনেক আদরে রাখেন ওদের আপনারা”।
হালকা সন্ধেকাল, পার্কের গেট ঠেলে বেরিয়ে এলেন, পেছন-পেছন আমি। আমার বাঙালিমুখ...ভারতীয়মুখ...পুরুষমুখের রেখাগুলোর ঢেকে তার ওপরে এসে বসেছো অন্ধকার। তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।

আহত-অনাহত
আমি ইজিচেয়ারে আসীন, সামনে দুই বাধ্য ছাত্র-ছাত্রী হয়ে ঝুঁকে সময় আর প্রকৃতি। না, আমার গায়ে পাড়-বসানো নাইটগাউন বা দাঁতে পাইপের শেষপ্রান্ত নেই, বাঁশঝোপের পাশ থেকে তাকিয়ে নেই কোনও মিডল-শট ক্যামেরাও। যদিও, ডাবের পাতলা শাঁসের মতো এক সিনেম্যাটিক আলোয় মিস্টার আকাশ মিস কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরেছেন।
এই মুহূর্তের পৃথিবী মিডিয়ার হাতের বাইরে, হয়তো আমার সীমার বাইরে এই আমিও। কথা বলতে গেলে মুখ থেকে বাংলা ভাষাই ধ্বনিত হবে, না “অনাহত নাদ”! মনের নিচে জ্বলতে থাকা বাসনার গ্যাস ওভেন নিবে আসে...বুঝতে পারি অর্ধেক শতাব্দীর জীবন নষ্ট করেছি প্রকৃত কোনও কাজ ছাড়াই। পৃথিবী থেকে দুহাতে যে আলো-বাতাস-অন্ন-বৈভব কুড়িয়ে নিলাম, আমারও তো কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার থাকে!
“কিত্তিটা দেখেছেন আজকের বাসে? আপনার নিশ্চয়ই খুব ইয়ে হচ্ছিল!” হোটেল ম্যানেজার এসে ধপাশ করে সামনে বসে গেলেন। “নেপালি ছেলে-মেয়েগুলো কলকাতা তো ছেড়েই দিন মশাই, লাস ভেগাস-টেগাসও বগলের তলা দিয়ে পার করে দেবে!“
ম্যানেজারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ল, শিলিগুড়ি আসার দিন হলদিবাড়ি এক্সপ্রেসে আমার মুখোমুখি বসে থাকা মানুষটার কথা। তার ডান চোখটি ছিল মণিবিহীন, ওপরে-নিচে ক্রুশচিহ্নের মতো ফালি করা। বোঝা যায়, কারও ছুরি-শিল্পের ছোঁয়ায় কালো এক পুষ্পকোরকের চেহারা অর্জন করেছে ওই চোখ। তিনি বাঁ-দৃষ্টিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন, আর খুন হওয়া চোখের অন্ধকার থেকে ধারাবাহিক জল গড়িয়ে নেমে গালের অর্ধেক ভিজিয়ে দিচ্ছিল। সামনে বসে সারা দুপুর খাবার মুখে তুলতে পারিনি আমি। এর চেয়ে বাসের ভেতর পরষ্পরের বুকের মধ্যে উঠে যাওয়া তরুণ-তরুণী কি অনেক ভালো দৃশ্য রচনা করছে না?

শেষ দৃশ্যে সাসপেন্স
চলে যাব। চরকির সঙ্গে সম্পর্কটা আর আপনি-আজ্ঞেতে পড়ে নেই। আবার এসো, হোটেলের দরজায় দাঁড়িয়ে সে বলল।
তুইও যাস পারলে!
এবার সেই ফিরোজা-রঙের বাস ছেড়ে দেবেন আমাদের হলুদ-গেঞ্জির ভ্যালেনটাইন। রাস্তার পাশে কিছু মাঝবয়েসি মরদ মদ টেনে রোদ পোয়াতে বসেছে। আবার হাফ-প্যান্ট পরা কয়েকজন দোকানের বড় ড্রাম ভর্তি করছে বালতি বালতি জল টেনে। জীবন কিছুতেই তোমার-আমার একরকম হতে পারে না।
রাস্তা তো নয়, যেন একমুখ সৌমিত্রের হাসি, এখানে “উফ”, তো ওখানে “উই মা”! কিন্তু ভ্যালেনটাইন জানেন, কোন আলগা পাথরের নিচে শক্ত জমি আছে, আর কোন ঘাসমাটি আসলে তোমাকে ধসিয়ে দেওয়ার ক্যামোফ্লেজ! মাঝপথে বাস থামিয়ে তিনি চাষির হাত থেকে সংগ্রহ করেন এখনও-লাফাচ্ছে পালং, নীলচে গাজর এবং আমার একতিলও সন্দেহ থাকে না, পৃথিবীর বিশুদ্ধতম দেশি মাখন, এই অ্যাত্তোটা! “ভওরেঁ কি গুঞ্জন অ্যায় মেরে দিল...” চালিয়ে দিলেন, সে কি আমার জন্যেই ট্রিবিউট! এবং দেখলাম, বাসের অন্তর্নিহিত সত্য একই রয়ে গেছে, জ্যামিতির সন্নিহিত কোনের মতো সেই ছেলে-মেয়েরা ---যে কোনও মুহূর্তে গায়ে দুর্ঘটনা গড়িয়ে পড়লেও যাদের অসীম বাক্যরচনা থামবে না।
লাভা-য় পৌঁছনো মাত্র আবার সে বৃষ্টি-ঝড়ের শিরস্ত্রাণ পরিয়ে দিল। শুনতে পাই, ধস নেমে কালিম্পং-শিলিগুড়ি রুট বন্ধ বলে ওদিককার মানুষজন এই পথেই গোরুবাথান হয়ে সমতলে নামছে। টইটম্বুর একটা ট্রেকার আসে, জায়গা নেই, পেছনে দাঁড়িয়ে যেতে পারেন। অ্যাঁ, মানে পাদানিতে! একবার আকাশের দিকে তাকাই, একবার নিজের নিয়তির দিকে!
কন্ডাক্টারও আমার সঙ্গে ঝুলন্ত-দণ্ডায়মান। বারবার শুধু বলতে থাকে, “হাথ ছোড়িয়ে মত”। কিন্তু ভিজে হাতে ভিজে গাড়ির হাতল...ডিভোর্স হয়ে যেতে কতক্ষণ!
তখন ওই অবস্থাতেই সে গল্প শুরু করে দিল --- যে অরণ্য রেখে যাচ্ছি দুপাশে, সেখানে কী কী “চমৎকার” রয়েছে! আর ঘুরে-ফিরে থিতু হতে চায় সাপের কাহিনিতে। বুঝতে পারলাম, আমার মতোই সে এক মোহগ্রস্ত মানুষ। মোহ থেকেই ভয় আসে, ভালোবাসা থেকে তো আসে না।
--- আমার বাবার মুখে শুনেছি, ভোরবেলা উঠে একদিন একটা লোক জঙ্গলে---
--- বাঘ মারতে গেছে তো?
--- না না, ওই সকালবেলার কাজ সারতে....
--- বুঝেছি, ওটাই ট্রেকারদের ভাষায় “বাঘ মারা”
শুনে একচোট হেসে নেয় সে।
--- তো, বাঘ মারতে জল লাগবে। লোকটা দেখেশুনে গাছের গুঁড়ির ওপর পোজিশান নিয়ে বসেছে, জলের বোতল কাছেই, মাটিতে। একটু পরে দেখে, বোতল যেন দূরে অনেক। উঠে গিয়ে বোতল সামনে নিয়ে বসল। একটু পরে আবার একই ব্যাপার। তিন-চার বার ওঠা-উঠির পর গুঁড়ির ওপর বসতেই সেটা একদম উলটে ডিগবাজি! লোকটা তখন দেখে কি, ওরে সর্বনাশ, গাছ-টাছ নয়, ওটা আসলে একটা বিশাল...
“পাইথন” ---দুজনে কোরাসে বলে উঠি!
ততক্ষণে তীব্র হাওয়া উড়িয়ে নিয়েছে আমার কানদুটো, মাথার চুল পরচুলা হয়ে খসে গেছে। শীকর-ভোজন করতে করতে বৃষ্টির যদি কোনও অসুর থেকে থাকে, আমি বেলুনের মতো ফুলে উঠে হয়ে গেছি তাই। যে-অসুর ছবি আঁকে অজগরের ক্যানভাসে। হয়তো সাপটা একটা বুনো শুয়োরের বাচ্চা গিলে ছ’মাস ধরে পড়েছিল জঙ্গলের ওইখানে। ভাবো, ছত্রাকের গোল গোল দাগে ভরে গেছে শরীর, কতো পোকামাকড় শান্তির বাসা বানিয়েছিল পেটের নিচে বা কতো শামুক-দম্পতির হানিমুনের ঠিকানা হয়েছে ওই নিশ্চল দেহপ্রকাণ্ড। গায়ের ওপর লতিয়ে ওঠা গুল্মে, উদ্ভিন্ন চারাগাছে সে বনাঞ্চল ছাড়া আর কিছু নয় এখন। আবার একবার খিদে পেলে ওই প্রাগৈতিহাসিক চলতে থাকবে, ত্বক থেকে স্থানুতার সব ছবি মুছে ফেলে সে তখন “টারমিনেটার থ্রি”। একটা শিকার অর্জনের পর আবার প্রকৃতিকে সঁপে দেবে দেহ, জীবনশিল্প ফোটানোর জন্যে।

গোরুবাথানে নেমে মালবাজারের গাড়ি খুঁজতে লেগেছে সবাই। আমার তাড়া নেই, পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে বিকেলের ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম। ডামডিম-এর দিকে এগিয়ে ডানহাতি পথ ধরতেই ছোট-বড় সরকারি অফিস, কোর্ট আর উলটো দিক থেকে নীল পুলোভারে ক্লান্তমুখ কিশোরির ঝাঁক। ওদিকে কোথাও স্কুল থাকবে তবে। আমিও ফিরে যাচ্ছি যেখানকার মানুষ, সেখানে। কিন্তু কে বারবার বলতো এখানে পালিয়ে আসতে? আমি মাঝেমাঝেই কার গলা শুনতে পেতাম! মনে হল, শীত-ডাকা সন্ধেয় আবার সেই অচেনা স্বরের ঝুমঝুমি বাজছেঃ

ব্ল্যাঙ্ক হয়ে আছে বুক
নিঃঝুম....নিশ্চুপ...
অগ্নিশিখা আনো
ছাইমাখা অর্গানও

বুকে আকাশের পা
মন --- তুমি শেরপা
বাতাসে কলার ওড়াও
লোলেগাঁও চলে যাও

No comments:

Post a Comment