Monday 18 August 2014

বোলপুরে বৃষ্টি

বোলপুরে বৃষ্টি

কপালে গোল সবুজ-আলো টিপ যাদের এখন, মানে যারা এইমাত্র গদ্যটা নিয়ে বসলে, আর যারা নেট বন্ধ করে অদৃশ্য হয়ে বাস্তব হয়ে আছো, সবাই শোনো। তখন আমি --- বাবু শ্রীবাস, বোলপুর নিবাস! সপ্তাহের শেষে অফিস থেকে বাড়ি, তারপর রবিবার সন্ধেবেলা পাড়ার মাঠের নিরাপত্তাকর্মী যে ঝাঁকড়া কদমগাছটা, তার নিচে ভিজে পরাগরেণু মেশানো চা খাই তিন-চার বন্ধুতে। পাশে রেলের লেভেল-ক্রসিং, তরকারি-বাজারের হলুদ বাল্বের আলোয় ফিগার দেখাচ্ছে ছিপছিপ বৃষ্টিকিশোরী। সেদিকে তাকিয়ে এক বন্ধু, বইয়ের দোকানে বসে যার সারাদিন গড়াতো --- “বোলপুরের বর্ষা কেমন রে! এখানকার মতোই?”
ধরো, কথাটা আমার কানেই ঢোকেনি। হতে পারে, ছ’টা পঞ্চান্নর বনগাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিয়ে স্টেশান পেরোচ্ছিল তখন। কতোদিন লোকাল ট্রেনের ভিড়ধাক্কা মাখি না গায়ে, আমার পরমাত্মার লোভী বেড়ালটার সে-কথা ভাবতে থাকাও কারণ হতে পারে। না হলে বিড়বিড় করে উঠবো কেন, আমরা যখন সদ্য চাকরি পেলাম, তখনও কি এতো লোক উঠত ট্রেনে? মোটেই না.........।

সকালের আটটা বেয়াল্লিশ ধরতাম। যেদিকে বসেছি --- আমি, ষষ্ঠীতলার তপনদা, কাশিমপুরের সুবীর মুখার্জী, উলটো কোনায় একজোড়া ছেলে-মেয়ে উঠতো পরের স্টেশান থেকে এমনভাবে যে, এ-বি-সি-ডি কামরা-চতুর্ভুজের সি(চন্দন) বিন্দু থেকে কর্ণ টানলে তাদের বসা(বি) ছুঁয়ে দেবে, যত খারাপ সম্পাদ্যই আমি আঁকি না কেন। এবার পাশাপাশি জানলার ধারে কোলের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে তারা কথা শুরু করতো। সারা রাস্তার সংলাপ।
তো, প্রেম আমার কাছে কাঞ্চনজঙ্ঘায় ভোরের রোদের দ্বিগুণ উচ্চতামাখা, একমাত্র প্রেমকে জেতাতেই ছাপ্পা ভোট মেনে নিতে পারি। যখন রাস্তায়-রেস্তোরাঁয় প্রেমিক-প্রেমিকা একে অন্যের দিকে মুখ তুলে তাকায়, যে কোনও দেবতামূর্তির চেয়ে সুন্দর সেই ফ্রিজ-ফ্রেম, সে-চোখের তারা স্পিভাক বা চ্যাপলিনের চেয়ে বেশি প্রতিভাবান। তখন মড়ক, শিশুহত্যা, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ --- নর্দমার জমা জল ছুঁতে পারে না কারও পায়ের পাতা, এবং কোনও ৪০৭-এর বাপের ক্ষমতা হয় না তাদের “তোদের বাড়ি যাব আজ” বা “খুব সাহস, না !”-র ওপর চালিয়ে দিতে গোল-গোল হিংসুটি দশচাকা। সিম্পলি পারে না!

তাই আমি লাইভ প্রেম দেখার জন্যে মাঝে-মাঝে লগ অন করতাম ওই সি-বি কর্ণ বরাবর, মানে ওই রোপওয়ে-পথে কভী কভী বসিয়ে দিতাম চোখজোড়া... যাও পাখি ঘুরে এসে ভ্রমণকাহিনি শুনিও। যদিও মার খেত সম্প্রচার, লোকজনের ওঠা-নামাতে লিংক ছিঁড়ে হারিয়ে যেত মুখদুটো, আবার ভেসে উঠেছে --- ছোটোবেলার রেডিও সিলোন! কিন্তু গভীর দুঃখের সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি খুব যেন জমেনি জুটিটা, একজন প্রকৃত দর্শক ও সাপোর্টার হিসেবে উদ্বেগ আমার সঙ্গী হয়ে গেল যখন সারাক্ষণ তার নিটোল ফর্সা তর্জনী তুলে মেয়েটা প্রেমিকের নাকের সামনে নাচাতে থাকে আর সেই ছেলে বিষণ্ণ মুখে বারবার মাথা নাড়িয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে নেয়। প্রেমিকার এক-বুক রাগী নালিশের সামনে সে এক অসমাপ্ত হাবুডুবু......মুখ নিচু করে যে নিজের অধঃপতিত অবস্থাটার ঠিক-ঠাক মুআয়না করবে, তারও সুযোগ তোকে দেব না শয়তান, কেননা ওই যে, বাঁ-কাঁধে কাঁঠালিচাঁপা আঙুলের খোঁচা, আবার শিরদাঁড়া সোজা করে বসো, ডাইনে-বাঁয়ে মুন্ডু নাড়ো পারকিনসন্স ডিজিজ!

কিছুদিন পরে আমারই ডিপ্রেশান হতে থাকলো। শচীন-শ্রীনাথের জুটির ওপর অতটা ভরসা রাখা উচিত হয়নি --- উনি এন্তারসে চার-ছয় হাঁকাতে ব্যস্ত, এদিকে পার্টনারের গায়ে কালশিটে দাগ বাউন্সারের, কোনওভাবে উইকেট বাঁচিয়ে রাখার খেলা খেলছে! ট্রাজেডি নিতে পারি না বলে আমি আজীবন শেক্সপীয়ার-মূর্খ জীব......... তাই, সি-বি কর্ণের ওপর ধুলো জমতে থাকল, শুকনো পাতার খড়খড়িয়ে প্রস্থানের নিচে ঘাস গজালো আস্তে, দৃষ্টিচিহ্ন মুছে দেবে বলে।

বেশ কিছুদিন পর......হয়তো বন্ধুরা আসেনি, হয়তো হাতের বইয়ে মন বসছে না, চোখ অন্যমনস্কভাবে হাঁটা লাগায় পুরনো পথে আর এক আশ্চর্য ছবি দেখে মাঝপথেই আনন্দময় বৃষ্টিময় হার্ট অ্যাটাকের মতো হয়ে যায়! সেই মেয়ে --- যার কাঁধ থেকে জলপ্রপাতের মতো নামা দুটো হাত নিজেরই কোলের ওপর বুড়বুড়ি কাটছে আর চিবুক একটু ডুবে এসে এই প্রথম মাথার সরু, প্রায়ান্ধকার সিঁথি দেখিয়ে দিল --- হাসছে সে! তার অপরাধী ও লাঞ্ছিত প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে হাসছে পূর্ণ খুশির, আরও এক কেজি অবাক এখানে যে, সেই হাসি লাজুক মুগ্ধতারও। তার মানে কতো কতো স্তবক মুখ-নাড়ায় একটা সোহাগের দাম, ভাবো!
আমারই চোখের সামনে এই প্রথম ছেলেটার শরীর থেকে বিষণ্ণতার শ্যামরঙ সরে গেল। এতদিনের দুঃস্বপ্নের জীবানু, মনখারাপের তেলচিটে গন্ধ...... সে হাঁটু মুড়ে বসেছে, হাসিস্নানে সব ধুয়ে নেবে!

No comments:

Post a Comment