Monday 18 August 2014

এ-তরী তোরই....

এ-তরী তোরই....

একঃ
মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়।
তার আগের একযুগ বছর, মা যখন শয্যা-ধরা, ঘরানার অনুবর্তন মেনে আলাপ শুরু হয়েছিল.......দিনেরাতে কয়েকটা পাতলা টোকার আওচার। 
আমার মা তীব্র মধ্যম! এমন কড়ি মা --- রোদের সরোদে ঘাট-কাটা না-ই থাকুক, একটা সপাটে অতি-তারের ষড়জ ছুঁয়ে দিতো।
মায়ের বিনাশের পর আমার মায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব, যেহেতু আমি মরহুম হিসেবে তার কয়েক বছরের সিনিয়ার। আর বেঁচে থাকতেই জেনে গিয়েছিলাম, আমার টেঁসে যাওয়ার জন্যে কেউ (তুমি) দায়ি হতে পারে (পারো) না।

চোখ বন্ধ করে শৈশব ভাবি.....ছাই রঙের অলংকৃত বন্ধ ঘর একটা। ঢোকার আগে, পরে, এমনকি প্রবেশকালেও তাকে দরজা-ভেজানো দেখতে পাই। সেখানে বসে থাকতে থাকতে আপন-ঘনিষ্ঠ....এবার নিজের হাড়ের কুচকাওয়াজ শুনি, নিজের মাংসপেশীর লম্বা শ্বাস লেখার-টেবিলে মাথা রাখে।

যে-অস্তিত্ব আমরা নিয়ে জন্মেছিলাম, তা জন্মমাত্র চুরি গেছে; যাকে অর্জন করেছি --- হারিয়ে ফেলেছি নিজেরাই; তারপর চাপিয়ে দেওয়া সত্তা নিয়ে গোঙাচ্ছি বাকি আয়ুকাল। আরোপিত জীবনের আরেক নাম তো অবসাদ। যে-চরিত্র নিয়ে এসেছিলাম, সে কবিতা। যাকে আয়ত্ব করেছি, তাহা “সুস্থ থাকার ন’টি উপায়”। কাজেই যত প্রথম জীবনের কাছে যেতে চাই, তত দ্বিতীয় জিন্দগী ভুলি আর হাতে পাই তৃতীয় বেঁচে থাকা।

অথবা এমনও বলা যায় যে, আমাদের মর-অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সময় কখনও শেষ হবে না, মহাশূন্যের কিনারা নেই...তবু আয়ু সীমানা-মাপা। যখন কিশোর কাঠি-আইসক্রিম বা তরুণ কেমিস্ট্রি-বই আর ফেরত পেলামই না, তখন জীবন একটা স্বপ্নমাত্র। কোনওদিন কি ফিরে আসবে আমার গৌরবর্ণ পণ্ডিতমশাই বাবাটি বা রান্নাঘরে নিচুগলায় কচুশাক কুটতে থাকা দিদিমা? অস্তিত্ব এক ছাপানো আইডেন্টিটি কার্ড। তার সব সুখ মিথ্যে, যেমন রসগোল্লা পেটের মধ্যে চলে গেলেই তৎক্ষণাৎ তাকে মুখে পোরার বাস্তবটা মুছে যায়। শুধু আঘাতগুলোকে আপনি কোনও পরমাণু-বোমায় ঊড়িয়ে দিতে পারছেন না। চিউয়িংগাম-কষ্ট = শেষহীন বেঁচে থাকা (সমীকরণ ১)। এই অনুপাত দ্বিতীয় সমীকরণে বসিয়ে পাই, চোট বাধাহীন হলে তবেই প্রাণ চিরঞ্জীবী!

অনেকদিন ধরে আমার মন বলছে, ক্ষত-বিক্ষতর দুই সন্তানঃ অপদার্থ বড়টির নাম অবসাদ। মেয়ে দেখতে ভালো (কিন্তু, ভেতরে ভেতরে বদমাশ)....কবিতা।
দেখা হওয়ার আগে বা পরে, সামনে ও পেছনে থাকে দেখা না হওয়া। কাজেই যে কোনও সময়ের প্রস্থচ্ছেদ হাতে নিলে বোঝা যাবে, ছাড়াছাড়ি মিলমিশকে পরিষ্কার ২-১-এ হারিয়ে বসে আছে।

শূন্য এক ভারতীয়ের আবিষ্কার। বিচ্ছেদও কি তাই! 

দুইঃ
একদা পুব পাকিস্তান থেকে আমার বাবা-মা-দাদু-দিদিমার একটা মণ্ড হিলহিলে পেছল পানাপুকুরে তিনদিন গা ডুবিয়ে...কেউ ছ’মাসের পোয়াতি তো কেউ বাঁহাতের চারটে আঙুল নজরানা দিয়ে এসেছে সম্প্রীতিকে...বর্ডার পার হতে পেরেছ তো নাও, কলোনিতে পাঁচ কাঠা জমির উপঢৌকন ও ডোল একশত টাকা। মুলিবাঁশের বেড়ায়, টিনের চালে, মাটির ডোয়ায় ঘর তোলো। আমগাছ ও বৃষ্টিবাদল তোমার, আয়পয় ও স্মৃতিকষ্ট তোমার।

তাই মনকে খারাপ করার শক্তি আমার জন্মবেলা থেকে। রাস্তার ছোট ছোট ইঁটের টুকরোয় লাথি মারতে মারতে স্কুল যাওয়ার সময় মন খারাপ বাড়ির জন্যে, আবার বাড়ি ফেরার ওই রাস্তাতেই হাতের কঞ্চিবেতে কচুগাছের মুন্ডু এলিয়ে দেওয়ার সময় বুকে মোচড় স্কুলের লাগিয়া। পরীক্ষা এগিয়ে আসা, পুজো চলে যাওয়া, ছুটিতে দিদি-জামাইবাবুর কাছে বেড়াতে না যেতে পারা, বাবা দুর্গাষ্টমীর দিন মাংস কিনে না আনা, হরিলুঠে বেশি বাতাসার দখল না পাওয়া, নিজের দোষে রান আউট....পেট্রাপোল সীমান্তে সারসার ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে।

আরও কিছুটা বিষাদ পেতাম রেশনে মাইলো-কেরোসিন তেলের সঙ্গে মিশিয়ে। কেননা, আমাদের প্রতিপালন করত রিটায়ার্ড বাবা নয়, টাকা পাঠিয়ে টায়ার্ড সেজদা-সোনাদাও নয়, দোকানদার। এ-দেশিয় বিরাট খাম্বাওলা উঁচু দালানের বাইরে দাঁড়াতাম অন্ধ ভিখিরি, অফুরন্ত ডিঙ্গি পেড়েও জানলা-সমান করতে পারতাম না দুচোখ (কোনওদিনই পারবো না সে যতই লম্বা তুমি বলো আমাকে), আধো-অন্ধকার ঘরে স্লিপের পাতা আর কাঠের সিন্দুক নিয়ে বসে থাকা রোগা বসন্তদাগ কর্মচারির মুখ দেখতে পাবো না, কেন সে বিরক্ত-চোয়ালে, তাচ্ছিল্য-চোখে ঢালাও কেটে দিচ্ছে আমাদের চাল-গম-চিনির বরাদ্দ !

তার বেশ কিছু বছর পরে গানটা বেরলো, “হম খেলেঁ তুফানোঁ সে, ইস দিলকি অরমানোঁ সে....”। তখন বড় হচ্ছি, রীনা রায়কে পড়ার মতো বড়। নদীয়ায় নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর বাড়ির বকুল গাছটির মতো কী ব্যাঁকাচোরা সেই বৃদ্ধি...দাদার মারের হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে দৌড় আর থামাতে পারছি না, মা যে ডেকে নেবে তার উপায় নেই, আগেই বলেছি, গর্ভধারিণীর সঙ্গে আলাপই করাতে ভুলে গেছে সবাই তালেগোলে!

তার অনেকদিন পরে তোমাকে বলেছিলাম এই কলোনি-জীবন, যাকে কখনও খুব একটা নিম্নাঙ্গ-সংগীত বলে মনে হয়নি আমার, এই জন্যেই কী যে, রেডিওতে শোনা যেত হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন অ্যালান কনোলি, সম্মান জানিয়ে ভাষ্যকার উচ্চারণ করতেন একটু উদাত্তভাবে অ্যালান কনঔলি আর আমাদের বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া টুটা-ফুটা নিবাধুই কলোনিকে মনে হত ওই অস্ট্রেলিয় ফাস্ট বোলারের আদরের ছোটোভাই?

আর তোমার স্মৃতিশক্তিকেও প্রশংসা করতে হবে, যখন পলকা কাঠের ব্রিজের ওপর ট্রাক চাপিয়ে দেওয়াতে মড়মড় করছে আমাদের সম্পর্ক, টেলিফোনে খুব শান্ত ও দায়িত্বশীল গলায় বলেছিলে, “বেজন্মা,কলোনির মাল!” ওমনি এতক্ষণ অন্যমনস্ক রীনা রায়... দুধসাদা চুড়িদার, ফাঁকা পায়ে হেঁটে এসে শূন্য স্টেজে দাঁড়ালেন...” মাঝি ছোড় যাতা হ্যায়, সাহিল ছুট যাতি হ্যায়”...গাইতে গাইতে বিষণ্ণ চোখ উঠল ক্যামেরার দিকে, নিটোল ডান হাত মুজরা গায়িকার অস্ফুট ভঙ্গিতে মাথার ওপর যেই উঠেছে, ফ্রিজ হল সিনেমার পর্দা। 

তাহলে কবিই বানিয়ে দিলে তুমি আমাকে!
তিন
মানুষের নামের সঙ্গে তার স্বভাবের কোনও ওঠা-বসা নেই ভাগ্যিস, নয়তো কত ঘনঘন নামের জার্সি বদলাতে হতো, ভাবো।
অথবা এমনও হতে পারত --- একগুচ্ছ হাজব্যান্ডের নাম শীতলতা, এক-স্তবক স্ত্রী হল মনোমালিন্য (উলটোটাও ধরা যায়), কিন্তু সবার সন্তানই অনুশাসন।

ছাদের ঘরে উঠে পুরনো সিলিং-ফ্যান চালিয়ে দিলে আগে বেশ বানান করে ঘুরত --- ক্রান্তি। এখন দেখি সেও....ক্লান্তি...ক্লান্তি....ক্লান্তি.....নাম পালটেছে।

কলেজবেলা থেকেই অন্যের হেলমেটে মাথা গুঁজে লড়াই চালাতাম। কোনও শিরস্ত্রাণের নাম থিয়োডর অ্যাডরনো, কোনওটা হারবার্ট মার্কুস...এভাবে জেমস জয়েস বা অরুন্ধতী রায়, চার্লস ডিকেন্স অথবা লিওটার নামের প্রকাণ্ড মেঘসকলের আড়াল থেকে বন্ধুদের দিকে তীর ছুঁড়েছি তখন থেকে মেঘনাদ।

টেবিলে উপুড় পড়ে থাকতে থাকতে পেট-ফুসফুস গুলিয়ে ওঠে। কাল রাতে কী খেলাম মনে করার চেষ্টা করি...কাটজিয়ার “এলিজাবেথ কস্টেলো” থেকে কিছু পৃষ্ঠা হয়তো, যেখানে সিমপ্যাথির ওপর মোহনভোগ ভাষণ আর কগিটো আরগো সুম–এর হালকা কাঁচালংকা-ঝাল আলোচনা। একটা ক্যাপসুল রগের ভেতর দিয়ে গিলে নেবো কিনা ভাবা যাক.....সিসের খাপে মোড়া জীবনদায়ী অ্যান্টিবায়োটিক।

শুধু তোমার ওপর এই একটুফোঁটা অভিমান থেকে গেল যে, আমার পুরনো নামের ট্যাগ কান থেকে খুলে কবি-লেখা একটা কাগজ কপালে সাঁটিয়ে দিয়েছ, যেমন বিমান-বন্দরে বা মর্গে বা লোকসভায় দেওয়ার নিয়ম। অথচ এমন একটা কথাও তো জানি না যা পৃথিবীর অজানিত! স্কুলে কেউ কবিতা লিখলে বাকি সবাই “কপি কপি কপি”...বিনা আদরে তুমি সেই বাঁদরই বানালে আমায়। অথবা, খাসি বলাই কি ঠিক হবে? যে অণ্ডকোষ নেই, তাকে চেপে ধরে মুঠো থেকে টুপিয়ে পড়া অলংকার রাস্তায় ছুঁড়তে ছুঁড়তে আমি ছুটে যাচ্ছি আর পৃথিবীর সব বাঙালি মেয়ে বিরক্তিযোগে সরে দাঁড়ায়, সদ্য সাইকেল-শেখা ছেলে দেখলে বুড়ো মানুষ যেমন যুক্তিপূর্ণ অনিশ্চিতে মাঠের ভেতর নেমে যেতে থাকে।

যে-লোকটা খুব সম্ভব চিলিচিকেন-বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিল, বা বিগত সরকারের আমলে তাসের লাস্ট ডিলে পার্টনার থ্রি ডাইস-এ সাপোর্ট দেয়নি বলে ব্লক পর্যায়ের মিটিংয়ে বিষয়টা তুলতে আগ্রহী, পাশের বাড়ির বৌদির সঙ্গে দোলের দিন পাঁচটা মিনিট চেয়েছিল একান্ত আপন, তাকে তুমি কবি বানালে কেন গো সোনা, জানতে হলে ক্লিক করুন এখানে......

বাড়ির নিঃঝুম গেট দিয়ে মেরা-কুছ-সামান সহ অফিস-ফেরত ঢুকছি, নিজের পায়ের নিচে নিজেই চাপা পড়ার মতো একটা শামুক “খ্যাঁচ” হয়ে গেল। সে তো নিম্নবর্গের অমেরুদণ্ডী, খুলি নেই, তাই ব্রেন ছোট...কে জানে, মস্তিষ্কই নেই!
কোনও কোনও মানুষও ভেঙ্গে গেলে এমন ধারালো হয়ে ওঠে কিনা, আই ডিফার টু বেগ (প্রেম) থেকে আই বেগ টু ডিফার (কবিতা)-এ চলে যায় কিনা জানতে হলে ক্লিক....

প্রেম এক ফুলবডি পাঞ্জাব লরি। ট্রাপিজের দড়ি দিয়ে বাঁধা তোমার প্রিয় অ্যাশ কালারের ত্রিপলের গায়ে রোহতকের শিশির, ঝুমরিতলাইয়ার ঠুমরির সুর, কোয়াট্টম-এর নারকোলফুল বা বারিপদার বেনেবউ পাখির পালক। তারপর সেই যান কলকাতায় বন্ধ লেভেল-ক্রশিংয়ের সামনে পা ঠুকছে, ঘর্ঘর ইঞ্জিনের তাড়সে থিরথির করছে স্টিয়ারিংয়ে রাখা ড্রাইভারের কবজি, কেননা, তার লক্ষ্য গুদামঘর --- পিঠে চাপানো এত করুণা, দাবী, আঘাত, সংশয় সে আনলোড কোথায় করবে! শুধু দুপায়ের নিচে রুলটানা তিরিশ লেনের জাতীয় সড়ক পড়ে থাকে। নিজের বিষাদস্বপ্নঅতৃপ্তমাখোঁজা প্যাকেটগুলো সে মজবুরন ডেলিভারি দিক ওই পেনের ধুলোয়.....।

চার
প্রেমকে যদি পশমে মুড়ে কোনও বরফমাখা পাহাড়ে তুলে আনা যেত, ঠিক আছে --- নেপালি কিশোরের অন্ধকার পা-পেছলানো জিপে চড়িয়েই, তারপর প্রেমের বেড়ালশিশু-চোখদুটো টেনে ফুটিয়ে বলতাম, দ্যাখো গুঁড়োমশলা আবিষ্কারের আগে এটাই ছিল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সানরাইজ, যদি প্রেমকে হিমায়িত করে রাখা যেত কুয়াশাময় বৌদ্ধ মনাস্ট্রিতে উঠে যাওয়ার রাস্তায়, তবে এভাবে পচে উঠত না আমাদের সম্পর্ক! 

সে আমার খুব থুরথুরে-বয়েসি আত্মীয়, আর ফেরত পাবো না জেনেও হসপিটালে নিয়ে এসেছি। সাদা নার্স তাকে সাদা স্ট্রেচারে শুইয়ে সাদা দেওয়ালে পাশ দিয়ে সাদা দরজার ওপিঠে চলে যাবে। আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্ট্রেচারের ঠাণ্ডা হাতল ধরে থেকে ছেড়ে দেওয়ার সময় একটা ছোট্ট ঠেলা দিই.....যাও, ভেসে যাও প্রেম, তোমাতে গতিসঞ্চার হোক। বিজ্ঞানের নরম কাচ ভেদ করে, সভ্যতার অ্যানাসথেসিয়া জয় করে যদি বেরিয়ে যেতে পারো ওদিকের শূন্যতায়, মাছের কাঁটার মতো দেহে কোনও কসমিক বেড়াল মুখ দেওয়ার আগেই যদি ব্যক্তিগত আহ্নিকগতি ও অয়নকাল আবিষ্কার করতে পারো, তবে নীল গোলাকার স্মৃতির চারদিকে সেই আবর্তনপথ তোমাকে চাঁদের অমরত্ব এনে দেবে।

আই-ইউ মিশে গেলে আয়ু হয়, এই ছিল আমার শেষাতিরিক্ত বিশ্বাস। না হলে কীভাবে ভুলবো বন্ধুর ক্যান্সারে মৃত্যু আসলে আমারই অর্ধেক মরে যাওয়া, প্রতিবেশির আত্মহত্যা অনেক দূর পর্যন্ত আমারই ট্রেনের নিচে ঝাঁপ, অথবা সহকর্মীর প্রতি তার সন্তান নিষ্ঠুর হলে আমি কিছু ওই বৃদ্ধ মহিলা, কিছুটা তার মদ্যপ ছোট ছেলে।

যে চলে গেছে, তার ছায়া খুঁজে বেড়িয়েছি অন্য কারও “মধ্যে”, আর ছাপার ভুলে টানাটানির “মদ্যে” শুধু তার তলানি ফুটে উঠেছে। ধারাবাহিক উপন্যাসের মতো এক কিস্তিমাত যন্ত্রনা শরীর, প্রতিদিনের জীবন, স্মৃতি আর ভাষাশক্তি ধুঁধলা করে বসে থাকে। তবু এটা তো ঠিক যে, কোনও না কোনও কাজ নিষ্পন্ন করতেই এসেছি আমরা সম্পর্কের কাছে। যেদিক থেকে প্রথমে মেটে, হাততালির গিফট ভাউচার সেদিকেই এগিয়ে যাক। 
পরীক্ষা-হলে আগে উত্তর লিখে খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে গেলে আমরা তাকে মেধাবী বলি কি না! 
পাঁচ

জীবনের তো কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। সে নিজেই সাইড এফেক্ট --- মৃত্যুর। যেমন প্রেমের রিঅ্যাকশান গায়ে লাল গোটা-গোটা অবসাদ, আর কবিতা লিখতে হয় বলে সব সময় ফুলহাতা শার্ট পরে থাকি --- অতিসুস্থতা কনুইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখার জিনিস। ট্রেনে-বাসে কারও সঙ্গে কথা না ব’লে বইমুখে....কারণ ঐ, মেয়েদের সঙ্গে অর্জিনাল চন্দনের বদলে সুশীলসমাজ ব্যবহার...কারণ ঐ, যাতে সবাই বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে বের না করে দেয় চাকরির খাপ থেকে, হারমোনিয়ামের সি-ন্যাচারাল থেকে, জীবনের শোক-প্রস্তাব থেকে এবং তারপর দিদিমার ভাষায় আমি “কেরমে কেরমে” রাস্তায় নেমে যাব। যে-উন্মাদ রেলস্টেশনে বসে আছে, একটু আগে কোলে দুটাকা ফেলে এলাম, মাথায় জটপড়া গাঁজানো চুলে উকুনে উকুন (টাকমাথা পাগল কেন আজ পর্যন্ত জন্মালো না!) --- ভালোই জানি, একই তড়িত-পরিবাহী দ্রবণে গুলে আছি আমি আর সে। আর মাত্র কয়েকটা দিন.....আমার হাইড্রোজেন পরমাণু খুলে গিয়ে লাগবে পাগলের মূলক-এর সঙ্গে......এই প্রতিস্থাপন বিক্রিয়াটির শেষে দেখতে পাই, আমি ঠিক ওই একই পোজ-এ দু’পা সামনে ছড়ানো --- চাপচাপ ময়লা বুকে-পিঠে, পায়ে অ্যাঙ্কলেট পরার জায়গায় একটা মাছি-ওড়া ন্যাকড়া --- বিড়ির টুকরো আর ধুলোর কোষপ্রাচীরে বাঁধা গোল থুতুর মাঝখানে বসে আছি; ফাটা প্যান্টের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে অণ্ডকোষ যা বহুদিন আগেই কর্তিত।

তারপর স্বপ্নে-পাওয়া স্বপ্ন ফলো ক’রে লম্বা কালো নাকের ভেতর লাল পিঁপড়ের জন্ম, জলের গ্লাস থেকে গলার ভেতর অসাবধানে ঢুকে প’ড়ে দুই ফুসফুসের মধ্যে দুটো টিকটিকির লাফ; ছেঁড়া রাবারের চটি, পুরনো খবরের কাগজ, খালি ওষুধের পাতা দিয়ে বাঁধা-ছাঁদা আমার পুঁটলির নিচে লুকনো মাইক্রোফোন, না হলে তোমরা শুনছো কী করে অহীন্দ্রকালের নাটকের পুনরাভিনয়.....!

শেষ শটের ওপর ড্রপসিন ফেলতে গিয়ে আমার প্রথম দৃশ্যটা মনে পড়বেই। আহা, গান ছিল ওই এপ্রিল-মুঠোয়!

সে আমার ভোরের আকাশে হাওয়া-মিঠাইয়ের মতো মেঘ
সে আমার মনের শেকড়ে তিস্তার গতিবেগ
সে আমার বেকহ্যামের মাপা পাসে খুলে যাওয়া জীবন-দরোজা
তার জন্যে অপমান.....বন্ধুর বিদ্রূপ সওয়া সোজা, খুব সোজা

আপনার লেখা? জিগেস করল “সে”। তার আগে হাতদুটো কোলের ওপর রেখে মুখনিচু বসে রইল প্রায় তিন মিনিট (পরে এডিট হবে)। একমাথা খোলা ভিজে চুল দেখাবে বলেই হয়তো আজ দুপুরে ডেকেছে আমায়....
আপনারই সুর? ব’লে মকরমুখী সোনার বালা থেকে চোখ তুলেছে এবার। বলো তো, কোথায় রাখবে! রাখা হল আমার বাদামি পাঞ্জাবির ডান কাঁধের ওপর।
আরও অপেক্ষা চাইছিলাম। যখন দেখি, বিনা প্রশ্নে সে বিশ্বাস করেছে তারই জন্যে গানখানি এবং যেহেতু গোটা দৃশ্যটাও এই প্রত্যয়ে সম্পূর্ণ একমত, অভিনীত চরিত্রের সঙ্গে সে কতটা অন্তরঙ্গ, বুঝতে আমার বাকি থাকে না।

মনে হল, চেতনার গা থেকে বাদামের লালচে খোসার পর্দা উঠে যাচ্ছে এবার।
মনে হল, জীবনের শেষে নয়, ভেতরে আছে মৃত্যু, সমান-সমান জল আর অ্যালকোহলের মিশ্রণে এক অলীক অলিভ তেলের ফোঁটা, একই ঘনত্ব....দুলে দুলে বেড়াচ্ছে আয়ুময়; এবার তাকে কোথায় বসতে দেবে, তোমার ব্যাপার!

কেননা, ঈশ্বরের চেয়ে মানুষের গড় আয়ু বেশি, এবং নিজের মডেলে আমাদের বানিয়েছিলেন ব’লে ঈশ্বরের ডেথ সার্টিফিকেটে সই হওয়ার পর (তাঁর মহান আত্মা শান্তি পাক) মানুষও অনস্তিত্ব। কিন্তু মানুষের তৈরি মানব-সমাজ থেকে যায়, শুকনো খাতে নদী অর্থাৎ জল-সমাজ ব’য়ে যাওয়ার মতো। এই কথাবাক্য যেতে যেতে শেষ সত্যি বলল ---- প্রেম নেই। কিন্তু প্রেমিক রয়েছে।
যেদিন মেঘের ধস আকাশে, বাতাসে মিশ্রণ হয় সন্ধে-কণার, বুনো ঘাসের পিঠে সমবেত বৃষ্টিবেত নামে, আমি হেঁটে হেঁটে দূরের মাঠের মাঝখানে যাই। মুখ তুললে শূন্যতা-স্নাত শূন্যতা। জিগ্যেস করিঃ বলো, আমরা কি পৃথিবীতেই এসেছিলাম, না একে অন্যের কাছে?  

No comments:

Post a Comment