Monday 18 August 2014

বাস্তবতা কী?/স্টিফেন হকিং আর লিওনার্দ লোদিনো (অনুবাদ আমার)

(স্টিফেন হকিং আর লিওনার্দ লোদিনো-র লেখা “দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন” বইয়ের ‘হোয়াট ইজ রিয়ালিটি’ প্রবন্ধের কিছু অংশ। অনুবাদ আমারই।) 

বাস্তবতা কী?

কয়েক বছর আগে ইতালির মোনজা শহরের পৌরসভা গৃহপালিত পশু-পাখির মালিকদের গোল পাত্রে গোল্ডফিশ রাখার ওপর নিষেধ জারি করেন। ব্যবস্থাগ্রহণকারীরা তার পদক্ষেপের কিছুটা ব্যাখ্যা দেন এই বলে যে একটা মাছকে বক্রতল-বিশিষ্ট পাত্রে রাখা একরকম নিষ্ঠুরতা, কেননা বাইরের দিকে তাকালে মাছ বাস্তবের একটা অযথার্থ চেহারা দেখছে। কিন্তু আমরা কী করে জানতে পারলাম যে আমাদের কাছেই বাস্তবের সত্য ও অবিকৃত চেহারাটা আছে? এমন নয় তো যে আমরাই রয়েছি বড়ো গোল্ডফিশ-পাত্রের ভেতর আর একটা বিশালাকায় লেন্স আমাদের দৃষ্টি বিকৃত করে দিচ্ছে? গোল্ডফিশের বাস্তবের প্রতিচ্ছবি আমাদের চেয়ে আলাদা, কিন্তু আমরা কি নিশ্চিত হতে পারি যে সেটা কম বাস্তব?

সোনালিমাছের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সঙ্গে মেলে না, তবুও তারা বৈজ্ঞানিক নিয়মের সূত্র আবিষ্কার করতে পারে যার সাহায্যে পাত্রের বাইরে দেখা বস্তুর গতিবেগ শাসন করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলি, একটা স্বাধীন ভ্রমণশীল বস্তু যেটা আমাদের চোখে সরলরেখায় চলছে বলে মনে হয়, বিকৃতির জন্যে ওদের চোখে বক্ররেখা-অনুসরণকারী হিসেবে ধরা দেবে। সে যাই হোক না, সোনালিমাছ তাদের বিকৃত দৃশ্য-বাস্তবতা থেকেই বৈজ্ঞানিক সূত্র প্রণয়ন করতে পারে যেটা তাদের ক্ষেত্রে সবসময়ই সত্যি হবে এবং যার সাহায্যে পাত্রের বাইরের বস্তুর ভবিষ্যত গতির ব্যাপারে অনুমান করতেও সক্ষম হবে তারা। আমাদের দৃশ্যজগতের নিয়মগুলো থেকে ওদেরটা আরও জটিল, কিন্তু সরলতা তো কেবলমাত্র রুচির ব্যাপার। কোনও গোল্ডফিশ এমন থিয়োরি তৈরি করলে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবের অকাট্য দৃশ্য হিসেবে আমাদের মেনে নিতেই হবে।

পার্থিবতার পৃথক ছবির একটা উদাহরণ হল মহাজাগতিক বস্তুর গতি বর্ণনার জন্যে ১৫০ খ্রিস্টাব্দে আনা টলেমি-র (৮৫ এ.ডি.-১৬৫ এ.ডি.) মডেল। টলেমি তার আবিষ্কারটি প্রকাশ করেছিলেন ১৩ খণ্ডের এক বইতে সাধারণত যা আরবী নাম “আলমাজেস্ট” হিসেবেই পরিচিত। পৃথিবীর যে গোলকের মতো আকার, সে যে নিশ্চল হয়ে ব্রহ্মাণ্ডের মাঝখানে বসে আছে আর মহাকাশের সঙ্গে দূরত্বের তুলনায় তার আয়তন হিসেবে-না-আনার মতোই ছোট --- আলমাজেস্ট শুরু হচ্ছে এর কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে। আবার কোপার্নিকাস ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে এমন এক পৃথিবীর বর্ণনা দিলেন যেখানে সূর্য স্থির আর গ্রহগুলো বৃত্তাকার পথে পাক খাচ্ছে তার চারদিকে।

এখন, কোনটা বাস্তব, টলেমি না কোপার্নিকাসের নকশা? যদিও মানুষজনের পক্ষে এটা বলা অস্বাভাবিক নয় যে কোপার্নিকাস টলেমিকে ভুল প্রতিপন্ন করলেন, কিন্তু তা সত্যি হবে না। যেমন আমাদের স্বাভাবিক দেখা বনাম সোনালিমাছের দেখা --- যে-কেউ এর কোনও একটা ছবি ব্যবহার করতে পারে ব্রহ্মাণ্ডের মডেল হিসেবে, কেননা জগত-ব্যাপারে আমাদের পর্যবেক্ষণকে পৃথিবী বা সূর্য, যে-কোনও একটিকে কেন্দ্রে রেখেই ব্যাখ্যা করা যায়। মহাবিশ্বের প্রকৃতি নিয়ে দার্শনিক বিতর্কে এর যা-ই ভূমিকা হোক না কেন, কোপার্নিকাসের ছাঁচের আসল সুবিধে স্রেফ এটুকু যে গতিবেগের সূত্রগুলোর সমীকরণ সেই নকশাতে অনেক সরল যেখানে সূর্য স্থির অবস্থায় আছে।

এক ভিন্ন ধরণের বিকল্প বাস্তবতা দেখা গিয়েছে সায়েন্স ফিকশান সিনেমা “দ্য ম্যাট্রিক্স”-এ। এই ফিলমে মানুষ নিজের অজান্তে বুদ্ধিমান কম্পিউটারের তৈরি এক সিমুলেটেড অপ্রকৃত (virtual) বাস্তবতার মধ্যে বাস করছে যেখানে তারা শান্ত আর সন্তুষ্ট থাকে আর সেই ফাঁকে কম্পিউটার মানুষের জৈব-বৈদ্যুতিক শক্তি (জিনিসটা যাই হোক না কেন!) শুষে নেয়। এই ভাবনা হয়তো খুব বেশি কষ্টকল্পিত নয়, কেননা অনেক মানুষই ওয়েবসাইটগুলোর অনুকারক (simulated) বাস্তবতার মধ্যে সময় কাটাতে পছন্দ করে, যেন এটা তাদের দ্বিতীয় জীবন। কিন্তু আমরা কীভাবে বুঝলাম যে, মানুষ কম্পিউটারের তৈরি টিভি সিরিয়ালের কিছু চরিত্র নয় শুধু? যদি একটা বানানো কাল্পনিক জগতে বাস করতাম, তবে ঘটনার কোনও যুক্তিগ্রাহ্যতা বা ধারাবাহিকতা থাকত না, ঘটনারা মেনে চলত না কোনও নিয়মও। ওই ভিনগ্রহের প্রাণী, (ফিলমে) আমরা যাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছি, আমাদের প্রতিক্রিয়া তাদের আরও বেশি ইন্টারেস্টিং বা মজার লাগত। ধরুন, গোটা চাঁদ ভেঙ্গে অর্ধেক হয়ে গেল অথবা পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের ব্যানানা ক্রিম পাই-এর ওপর সামলানো যাচ্ছে না এমন ভয়ানক লোভ তৈরি হয়েছে। কিন্তু যদি অন্য গ্রহের প্রাণীরা নতুন কোনও নিয়ম প্রণয়ন করে ফ্যালে, আমরা কোনওভাবেই তাদের জানাতে পারব না যে এই ছদ্মবেশী বাস্তবের বাইরেও একটা বাস্তবতা ছিল। বরং, তখন অ্যালিয়েনরা যে-পৃথিবীতে বাস করে সেটাকেই “সত্যি” বলা ঠিক হবে আর সিন্থেটিক পৃথিবীকে “মিথ্যে”। কিন্তু আমাদের মতোই অনুকারক জগতের সত্তারাও যদি বাইরে থেকে তাদের ব্রহ্মাণ্ডকে দেখতে না পায়, তবে তাদের নিজেদের রিয়ালিটির ছবিকে সন্দেহ করার কোনও কারণই থাকবে না। এটা হল সেই চিন্তার আধুনিক চেহারা যা বলে, আমরা প্রত্যেকেই অন্য কারও স্বপ্নের আবিষ্কার! 

আগের উদাহরণগুলো থেকে এই বইয়ের পক্ষে দরকারি একটা সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসেঃ বাস্তবতার কোনও দৃশ্য বা তত্ত্ব-নিরপেক্ষ ধারণা হয় না। বরং এবার আমরা সেই দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করব, যার নাম মডেল(নকশা)-নির্ভর বাস্তবতা। ধারণাটা এই রকমঃ একটা ভৌত তত্ত্ব বা জগত-ছবি হল একটা নকশা (সাধারণত অঙ্কের ধাঁচের) আর এক গুচ্ছ নিয়ম দিয়ে তৈরি, যে নিয়ম নকশার উপাদানগুলোকে পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত করে।
এর ফলে একটা কাঠামো পাওয়া গেল যার সাহায্য নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করা যাবে।

প্লেটো ও তার পরের দার্শনিকেরা বছরের পর বছর বাস্তবতার স্বরূপ নিয়ে তর্ক করে গেছেন। ধ্রুপদী বিজ্ঞান এই বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে, একটা সত্যিকারের বাস্তব বহির্জগত রয়েছে যার চরিত্রধর্ম নির্দিষ্ট এবং তাকে যারা অনুভব করছে তাদের উপস্থিতি-নিরপেক্ষ সেটা। ধ্রুপদী বিজ্ঞান অনুযায়ী কিছু বস্তু অস্তিত্ববান; তাদের ভৌত বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন গতি বা ভর --- যে গতি বা ভরের স্পষ্টভাবে নির্ধারিত মানও রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে আমাদের তত্ত্বগুলো সেই বস্তু ও তাদের ধর্ম বর্ণনা করার চেষ্টা করে, এবং আমাদের পরিমাপ আর প্রত্যক্ষ উপলব্ধি সেই বর্ণনার সঙ্গে মিলেও যায়। এখানে যাকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে আর যে পর্যবেক্ষণ করছে, দুটোই জগতের অংশ যে জগতের বস্তুগত অস্তিত্ব আছে, এবং এদের মধ্যে পার্থক্যের কোনও অর্থপূর্ণ তাতপর্য নেই। অন্য ভাষায় বলা যায়, আপনি যদি দেখেন একদল জেব্রা কোথাও কার পার্কিংয়ের জায়গা পাওয়ার জন্যে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে, তার কারণ বাস্তবিকই তারা একদল জেব্রা যারা কোথাও কার পার্কিংয়ের জায়গা পাওয়ার জন্যে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। যারা যারা ঘটনাটা দেখছেন, প্রত্যেকেই এই একই বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাবেন। এবং জেব্রাদল একই চরিত্রবৈশিষ্ট্য ধারণ করে থাকবে তাদের কেউ দেখুক চাই না দেখুক। দর্শনে এই বিশ্বাসের নামই বাস্তববাদ (realism)।

রিয়ালিজম একটা লোভনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চয়ই, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এর পক্ষে দাঁড়ানোটা মুশকিল করে তুলেছে। উদাহরণ দিইঃ কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার নীতি অনুযায়ী (যা কিনা প্রকৃতির একেবারে নিখুঁত বর্ণনা দেয়) একটা কণার না আছে নির্দিষ্ট অবস্থান, না নির্দিষ্ট গতিবেগ যতক্ষণ না পর্যন্ত ওই পরিমানগুলোকে কোনও পর্যবেক্ষক মেপে নিচ্ছে। কাজেই --- কোনও পরিমাপ কোনও নির্দিষ্ট ফলাফল দেয় এইজন্য যে, যাকে মাপা হল সেই সময় তার ওই মাপই ছিল --- একথাটা বলা ঠিক হবে না। সত্যি বলতে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে একক বস্তুর নির্দিষ্ট অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই, বরং তারা অনেকগুলো পদার্থের সমাহার হিসেবে অবস্থান করে। আর, হোলোগ্রাফিক নীতি নামক তত্ত্বটা যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তবে আমরা আর আমাদের চারমাত্রিক পৃথিবী পাঁচমাত্রার স্পেস-টাইমের সীমানায় একটা ছায়ার মতো আছি। সেক্ষেত্রে ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের অবস্থা গোল্ডফিশের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

কঠিনরকম বাস্তববাদীরা প্রায়ই তর্ক করেন যে তারাই সফল, কেননা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু ব্যাপারটা হল, আলাদা আলাদা তত্ত্ব একই ঘটনাকে সার্থক ভাবে বর্ণনা করতে পারে একেবারে অসদৃশ ধারণাগত কাঠামোর সাহায্যে। আসলে, অনেক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে --- যেগুলো সফল বলে প্রমাণিত --- পরে অন্য তত্ত্বেরা এসে সরিয়ে দিয়েছে, যারা বাস্তবতার নতুন ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি এবং একইভাবে সফল।

ঐতিহ্যগতভাবে যারা বাস্তববাদকে স্বীকার করেন না, সেই বিরোধীকুল মনে করছেন, তাত্ত্বিক জ্ঞান আর পর্যবেক্ষণ-জনিত জ্ঞানের মধ্যে একটা তফাত আছে। তারা ঠিক তাদের স্বভাব-মতোই যুক্তি দেখিয়ে বলেন যে, পর্যবেক্ষণ আর পরীক্ষা অর্থপূর্ণ ব্যাপার নিশ্চয়ই, কিন্তু তত্ত্ব একটা সুবিধেজনক অস্ত্র ছাড়া কিছু নয় যেটা এমনকি যাকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে সেই বাহ্যমূর্তি(phenomena)-কে বিশেষভাবে চিনিয়ে দেবে এমন কোনও গভীরতর সত্যকেও ধরতে পারে না। বাস্তবতা-তত্ত্বের বিরোধী কিছু মানুষ তো বিজ্ঞানকে শুধু সেইসব বস্তুতেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান যাদের দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক এই কারণে উনবিংশ শতকের অনেকে অণুর ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কেননা, আমরা কোনওদিন একটা অণুও চোখে দেখব না। জর্জ বার্কলে (১৬৮৫-১৭৫৩) এতদূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন যে বলে বসেন, মন আর তার চিন্তা ছাড়া আর সব কিছু অস্তিত্বহীন। ইংরেজ সাহিত্যিক ও অভিধান-রচয়িতা ডক্টর স্যামুয়েল জনসন (১৭০৯-১৭৮৪)-এর কাছে তার এক বন্ধু যখন মন্তব্য করেন যে বার্কলে-র দাবী খুব সম্ভবত খণ্ডন করা যায় না, শোনা যায় জনসন বড় একটা পাথরের চাঁইয়ের কাছে হেঁটে গিয়ে সেটায় এক লাথি বসিয়ে বলেন, “আমি এইভাবে খণ্ডন করলাম”। অবশ্য জনসন পায়ে যে ব্যথাটা পেলেন, সেটাও তার মনেরই একটা আইডিয়া, কাজেই তিনি যে বার্কলের মতটাকে যে খুব হারাতে পেরেছিলেন, তা হয়তো নয়। তবু জনসনের এই কাজ দার্শনিক ডেভিড হিউম(১৭১১-১৭৭৬)-এর দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে। হিউম লিখেছিলেন, যদিও আমাদের বস্তুগত বাস্তবতায় বিশ্বাস করার কোনও যুক্তিযুক্ত কারণ নেই, তেমনি এটা সত্যিই আছে ভেবে নিয়ে কাজ করা ছাড়া অন্য বিকল্পও নেই।

বাস্তববাদী আর বাস্তবতা-বিরোধী এই দুই দলের সব তর্ক আর আলোচনার বারোটা বাজিয়ে দেয় নকশা-নির্ভর বাস্তবতা। এই বাস্তবতা অনুযায়ী, কোনও নকশা সত্যি কিনা প্রশ্ন করার মানে হয় না, শুধু এটুকু দেখা দরকার যে সেটা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিলছে কী? আবার, যদি এমন দুটো মডেল থাকে যে দুটোই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সহমত হচ্ছে, যেমন গোল্ডফিশ আর আমাদের দেখা বাস্তবতা, তাহলে কেউ বলতে পারবে না একটা অন্যটার চেয়ে ভালো। যে পরিস্থিতিকে বিচার করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর ক’রে কোনও মানুষ যে নকশাটা বেশি সুবিধেজনক, সেটাই ব্যবহার করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে গোল পাত্রের মধ্যে আছে, তার কাছে সোনালিমাছের দেখা ছবিটাই ঠিক-ঠাক হবে, আবার যে বাইরে আছে, তার কাছে পৃথিবীতে একটা পাত্রের ভেতরে বসে থেকে মহাকাশে কোনও দূরের ছায়াপথের বর্ণনা করা হয়ে পড়বে খুব বিদঘুটে একটা কাজ। কেননা, পৃথিবীর সূর্যের চারদিকে ঘোরা বা নিজের অক্ষে ওর পাক খাওয়ার জন্যে পাত্রটাও তো ঘুরতে থাকবে।
বিজ্ঞানের মতো প্রত্যেক দিনের জীবনেও আমরা মডেল তৈরি করি। নকশা-নির্ভর বাস্তবতা শুধু বৈজ্ঞানিক আদরা-র বেলাতেই প্রয়োগ করা হবে এমন নয়, প্রাত্যহিক পৃথিবীকে ব্যাখ্যা আর বোঝার জন্যে আমরা সবাই যে-সমস্ত সচেতন এবং অবচেতন মানসিক মডেল তৈরি করছি, তার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়। আমাদের দেখা-শোনার পৃথিবী থেকে পর্যবেক্ষক মানে “আমাদের” বাদ দেওয়া সম্ভব নয়, কেননা এই দেখা-শোনা তৈরি হয়েছে আমাদেরই পঞ্চেন্দ্রিয়-গ্রাহ্য অনুভব ও যেভাবে আমরা চিন্তা আর যুক্তিবিচার করি, তার ভেতর দিয়ে। মানুষের ইন্দ্রিয়-নির্ভর দেখা-শোনা আর সেখান থেকে পাওয়া পর্যবেক্ষণ, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার তাত্ত্বিক জগত, সেটা খুব প্রত্যক্ষভাবে তৈরি হয়নি। বরং, এই চেহারাটা একধরণের লেন্সের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছে, যে লেন্স আসলে মানুষের মস্তিষ্কের ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা।
আমরা যেভাবে একটা বস্তু দেখি-শুনি, তার সঙ্গে নকশা-নির্ভর বাস্তবতা মিলে যায়। দৃষ্টিশক্তির বেলায়, অপটিক নার্ভ বরাবর মানুষ যে সার-সার সংকেত পায়, সেগুলো সেই ধরণের ইমেজ তৈরি করতে পারে না যা আমরা টেলিভিশনে দেখে অভ্যস্ত। যেখানে অপটিক নার্ভ রেটিনার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, সেখানে একটা অন্ধকার অংশ (blind spot) আছে, আর আমাদের চোখের দৃষ্টিক্ষেত্রে ভালো রেজোলিউশান (resolution) আছে, এমন জায়গাটা হল রেটিনার ঠিক মধ্যিখানে একেবারে সংকীর্ণ, এক ডিগ্রি মতো কৌণিক দৃষ্টি (visual angle ) --- একহাত দূরত্বে নিজের হাতের বুড়ো আঙুলটা ধরলে তার চওড়াই-টা যেমন হবে। কাজেই কাঁচা তথ্য (data, ভারি বাংলা “উপাত্ত”), যা মস্তিষ্কে পাঠানো হয়, হল খারাপ পিক্সিল-এর ছবি, যার মধ্যিখানে আবার একটা ছেঁদা! আমাদের কপাল ভালো যে মানুষের মস্তিষ্ক সেই তথ্য প্রসেস করতে পারে, দুচোখ থেকেই তথ্যের ইনপুট নিয়ে তাদের মেলায় আর এই আন্দাজ করে শূন্যস্থানগুলো ভরাট করে যে আশ-পাশের জায়গাগুলোর চাক্ষুষ বৈশিষ্ট্যও (visual property)একই রকম এবং প্রক্ষেপক (interpolating) চরিত্রের। এছাড়াও সে রেটিনা থেকে দ্বিমাত্রিক তথ্যগুলো নিয়ে তা থেকে একটা ত্রিমাত্রিক জায়গার ধারণা তৈরি করে। অন্যভাবে বলা যায়, ব্রেন এখানে একটা মানসিক ছবি বা মডেল তৈরি করছে।

আমাদের মস্তিষ্ক নকশা বানাতে এত দক্ষ যে, কোনও মানুষকে যদি এমন চশমা পরিয়ে দেওয়া যায় যাতে সে সব ছবি উলটো দেখবে, কিছুক্ষণ পরে মস্তিষ্ক মডেলটা বদলে নেবে যাতে আবার সে সব ঠিক-ঠাক দেখে। এবার চশমাটা সরিয়ে নিলে মানুষটা আবার অল্প সময়ের জন্যে সব উলটো দেখবে বটে, তারপর আবার ছবিটা সোজা করে নেবে। এ-থেকে বোঝা যায়, যখন কেউ বলে, “আমি চেয়ারটা দেখছি”, তার মানে শুধু এই যে সে চেয়ার থেকে বিচ্ছুরিত আলো ব্যবহার ক’রে চেয়ারের একটা মানসিক ইমেজ বা নকশা বানিয়েছে। যদি এই মডেলটা উলটো তৈরি হয়, কপাল ভালো থাকলে সে চেয়ারে বসার আগে তার ব্রেন ছবিটা সংশোধন করে নেবে!

আরেকটা সমস্যা যেটা নকশা-নির্ভর বস্তবতা সমাধান করে, বা অন্তত এড়াতে পারে, সেটা হল অস্তিত্বের অর্থ। কীভাবে আমি জানব যে টেবিলটা রয়েছে যদি আমি ঘরের বাইরে গিয়ে সেটাকে দেখতে না পাই? কিছু জিনিস আমরা দেখতে পাই না, যেমন ইলেকট্রন বা কোয়ার্ক, এর মানে কী? যে কণিকাগুলো প্রোটন বা নিউট্রন গঠন করে তারা অস্তিত্ববান নয়? কেউ এমন একটা মডেল তৈরি করতে পারে যে আমরা ঘর থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই টেবিলটা অদৃশ্য হয়ে গেল, আবার ফিরে এল যেই আমরা ঘরে ঢুকেছি। কিন্তু ব্যাপারটা একটু বিদঘুটে হয়ে যাবে। তাছাড়া তখন কী হবে, যদি আমি বাইরে থাকার সময় কিছু ঘটে, ধরা যাক... ছাদটা ভেঙ্গে পড়ল? আমি তো আমি-ঘরে-না-থাকলে-টেবিলটা-উবে-যায় মডেল-এর লোক, কীভাবে এই ব্যাপারটা হিসেবে ধরব যে, পরের বার যেই ঘরে ঢুকলাম, টেবিলটার পুনরাবির্ভাব হল ভাঙা অবস্থায়, ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে? তার চেয়ে যে মডেলে টেবিল থেকে যায়, সেটা অনেক সরল আর পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিলেও যাবে। এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারি আমরা!

No comments:

Post a Comment