Monday 18 August 2014

বিনয় মজুমদার

বিনয় মজুমদার

উনিশশো চুরানব্বই সালের শীতঋতু। কবি বিনয় মজুমদার মানসিক রোগে অসুস্থ, দিন পনেরো হল ভর্তি আছেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

কবির উন্মত্ততার কিছু চিহ্ন তখনও শান্তকারি ওষুধের প্রভাব ঠেলে বেরিয়ে পড়ছে। ডাক্তার ম্যাডাম ডেকে মন্ত্রণা দিলেন --- কতোদিন কবিতা লেখেন না, বিনয়বাবু? ওকে লেখাতে বসান আবার। অনেক সহজে নিরুত্তেজ হয়ে যাবেন।

ধরলাম গিয়ে। কিন্তু সব অনুরোধ ফিরতে লাগল বে-জবাব। শেষে এক ফুটকড়াই-বন্ধুর মুখ থেকে যেই বেরিয়েছে --- আহা, তোরা বোঝার চেষ্টা কর, উনি সত্যিই অনেকদিন কিছু লিখতে পারছেন না রে! শরীরটা কবে থেকে খারাপ, বল তো? --- আস্তে মাথা তুললেন বিনয়। তেরছা দৃষ্টি বকন্দাজ ছেলেটার দিকেঃ কাল সকাল দশটায় একখানা রুলটানা দু’নম্বর খাতা নিয়ে চলে আসবে। ঠিক দশটায়। দু’ঘন্টায় চোদ্দোটা কবিতা। আর, সামনের দু’পাতায় থাকল কবির নাম, প্রকাশকের ঠিকানা ইত্যাদি। ব্যাস, সুন্দর একফর্মার কবিতার বই। সাত দিনের মধ্যে ছেপে বার হয়ে যাবে।

ডান হাতের কম্পমান বুড়ো আঙুল আর মধ্যমা একজোট হল, চটাশ করে তুড়ি একখানা। মুখের ভাঁজরেখা, স্বচ্ছতাহীন চোখ, মাথার সাদা-কালো কঠিন চুল ---এই শীর্ণ পরাক্রমের কোথাও এক ভগ্নাংশ হাসি ফুটল কি? ওই হাসির কি জানা আছে, আগামিকাল সরস্বতীপুজো!

চারদিকে শহরের পরাধীন সন্ধ্যা নেমে আসছে। বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের কারও মুখে অরক্ষিত চিড়িয়াখানায় ঢুকে পড়ার উদ্বেগ, কেউ দাঁড়িয়ে জাদুঘরের প্রত্নশিলার সামনে, কেউ আবার তুচ্ছালোকিত তারামণ্ডলের মধ্যে চিনতে চাইছে কালপুরুষ। মানুষ একটাই, অথচ, নানা দর্শকের চোখে নানারকম সাইটসিয়িং-এর উত্তেজনা।

হঠাৎ ঘরভর্তি গুনগুন চুপ করে গেল। বিনয়ের কাঁপা কাঁপা তর্জনী উঠছে দেওয়ালের দিকে। বাইরে কলকাতার উচ্ছিষ্ট আকাশ। তাকে আঘাত করতেই কি ঠোঁটদুটো গুটিয়ে নখরের মতো হয়ে উঠেছে? না। ওই শূন্যতায় কবি নিজের কাব্যগ্রন্থটি দেখতে পেয়েছেন। কিছুক্ষণ বিনয়ী নীরবতা। তারপর একঝাঁক ক্ষুধিত কবি-শব্দ ছিটকে বেরিয়ে এল ---

পৃথিবীর সব প্রকৃত কাব্যগ্রন্থই এক ফর্মার।

(প্রকাশিত)

Photo: উনিশশো চুরানব্বই সালের শীতঋতু। কবি বিনয় মজুমদার মানসিক রোগে অসুস্থ, দিন পনেরো হল ভর্তি আছেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। 

কবির উন্মত্ততার কিছু চিহ্ন তখনও শান্তকারি ওষুধের প্রভাব ঠেলে বেরিয়ে পড়ছে। ডাক্তার ম্যাডাম ডেকে মন্ত্রণা দিলেন --- কতোদিন কবিতা লেখেন না, বিনয়বাবু? ওকে লেখাতে বসান আবার। অনেক সহজে নিরুত্তেজ হয়ে যাবেন।

ধরলাম গিয়ে। কিন্তু সব অনুরোধ ফিরতে লাগল বে-জবাব। শেষে এক ফুটকড়াই-বন্ধুর মুখ থেকে যেই বেরিয়েছে --- আহা, তোরা বোঝার চেষ্টা কর, উনি সত্যিই অনেকদিন কিছু লিখতে পারছেন না রে! শরীরটা কবে থেকে খারাপ, বল তো? --- আস্তে মাথা তুললেন বিনয়। তেরছা দৃষ্টি বকন্দাজ ছেলেটার দিকেঃ কাল সকাল দশটায় একখানা রুলটানা দু’নম্বর খাতা নিয়ে চলে আসবে। ঠিক দশটায়। দু’ঘন্টায় চোদ্দোটা কবিতা। আর, সামনের দু’পাতায় থাকল কবির নাম, প্রকাশকের ঠিকানা ইত্যাদি। ব্যাস, সুন্দর একফর্মার কবিতার বই। সাত দিনের মধ্যে ছেপে বার হয়ে যাবে।

ডান হাতের কম্পমান বুড়ো আঙুল আর মধ্যমা একজোট হল, চটাশ করে তুড়ি একখানা। মুখের ভাঁজরেখা, স্বচ্ছতাহীন চোখ, মাথার সাদা-কালো কঠিন চুল ---এই শীর্ণ পরাক্রমের কোথাও এক ভগ্নাংশ হাসি ফুটল কি? ওই হাসির কি জানা আছে, আগামিকাল সরস্বতীপুজো!

চারদিকে শহরের পরাধীন সন্ধ্যা নেমে আসছে। বিছানা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের কারও মুখে অরক্ষিত চিড়িয়াখানায় ঢুকে পড়ার উদ্বেগ, কেউ দাঁড়িয়ে জাদুঘরের প্রত্নশিলার সামনে, কেউ আবার তুচ্ছালোকিত তারামণ্ডলের মধ্যে চিনতে চাইছে কালপুরুষ। মানুষ একটাই, অথচ, নানা দর্শকের চোখে নানারকম সাইটসিয়িং-এর উত্তেজনা।

হঠাৎ ঘরভর্তি গুনগুন চুপ করে গেল। বিনয়ের কাঁপা কাঁপা তর্জনী উঠছে দেওয়ালের দিকে। বাইরে কলকাতার উচ্ছিষ্ট আকাশ। তাকে আঘাত করতেই কি ঠোঁটদুটো গুটিয়ে নখরের মতো হয়ে উঠেছে? না। ওই শূন্যতায় কবি নিজের কাব্যগ্রন্থটি দেখতে পেয়েছেন। কিছুক্ষণ বিনয়ী নীরবতা। তারপর একঝাঁক ক্ষুধিত কবি-শব্দ ছিটকে বেরিয়ে এল --- 

পৃথিবীর সব প্রকৃত কাব্যগ্রন্থই এক ফর্মার।   
 
                                                                                চন্দন ভট্টাচার্য

No comments:

Post a Comment