Monday 18 August 2014

কিশমিশের কাহিনি (গল্প)

কিশমিশের কাহিনি

বেড়াল দেখলেই আমার মাথা গরম হয়ে যায় – মা’র মুখে এই কথাটা যে কতবার শুনেছে পুক্কা। আর অবাক হয়ে ভেবেছে, তার নিজের কেন ঠিক উল্টোটাই হয়ে থাকে! প্রথমেই মনে হয়, আহ, চান না করেই ওরা কেমন সাদা সাদা ডালিয়া ফুল, ঝকঝকে। তারপর বুড়ো-অশ্বত্থগাছ বেড়ালগুলোও কত আদুরে, পিঠে হাত ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই গলায় গার্গল করার মতো শব্দ। মুখের দিকে ঠায় তাকিয়ে এমন বসে থাকবে, এতবার মিউ মিউ ডাকবে যে সন্দেহই থাকে না তোমার দেওয়া মাছের কাঁটাটা, পাঁউরুটির টুকরোটা, এমনকি সকালের মুড়ির বাটি থেকে মেঝেয় ছড়ানো মুড়িগুলো তাড়া করে খেতে পারছে বলেই ও বেঁচে আছে। আশ্রিতকে ত্যাগ করা ঘোর অন্যায় --- এটা বাবার উক্তি।

আর কিশমিশই তো তাদের একমাত্র আশ্রিত। কিন্তু বেচারা বাবার শাস্ত্রবচন কোনও কাজে এল না! ফাঁকা রেলস্টেশনে হাতে একটা বাজারের থলে ধরে দাঁড়িয়ে ভাবছিল পুক্কা। আর এর জন্যে দায়ি বাবাই...না না, বাবার অসুখ। শীতের দুটো মাস বাড়ির পরিস্থিতি একদম পালটে যায়। বাজারে চৌমাথায় তাদের বইয়ের দোকানটা বন্ধ আর বাড়িতে ভোরবেলা থেকে বাবার নিঃশ্বাসও আটকে আসছে কাশির তাড়সে। মা একবার গরম জল এনে দেবে তো একবার তুলসি আর বাসকপাতা মেড়ে সেই রস মধুতে মিশিয়ে মুখের সামনে ধরবে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। শেষ পর্যন্ত বিষ্ণু ডাক্তারের বড়ি...খাওয়ানো-মাত্র বাবা অবশ, ঘুমোচ্ছে, মাথা তোলার শক্তিটুকুও নেই। গতবছর পাড়ার দোকান মেডিসিনো-র অঞ্জনকাকু বলল, বউদি, একবার কষ্ট করে শ্রীবাস্তবকে দেখিয়ে নিন, বুকের ডাক্তার, এম ডি। ব্যাস, শ্রীবাস্তবকে দেখানো অবদি মা কিশমিশের ওপর আরও চটা। তুই আপদ বিদেয় করবি এক্ষুনি, শুক্কুরবার কালীপুজোটা যাক। ওগুলোর জন্যেই এ-বাড়িতে আর অসুখবিসুখ ফুরোতে পায় না। সাধে কি আর বেড়াল দেখলে আমার মাথা...।

ট্রেন থেমেছে বামনগাছিতে, তাদের দত্তপুকুরের আগের স্টেশান। কিশমিশকে ব্যাগ থেকে বার করল পুক্কা। তার পর ট্রেনটা ছেড়েছে যেই, আস্তে করে নামিয়ে দিল প্ল্যাটফর্মে। কিশমিশ ভেবেছে পুক্কাও নামবে, ছুটছে ট্রেনের পাশে-পাশে। তারপর বেড়ালের ইন্দ্রিয় যখন টের পেল, ব্যাপারটা সুবিধের নয়, একটা প্রাণপণ ঝপাং। কিন্তু রানিং করা তো শেখেনি, উঠেই গড়িয়ে গেল, মাথা ঠুকল লোহার দেয়ালে। তৎক্ষণাৎ ওকে কোলে তুলে নিয়েছে পুক্কা। কিশমিশ চার হাতপায়ে ওর ডান কব্জিটা আঁকড়ে ধরে যেন বলছে, আমাকে আমার নামিয়ে দেবে না তো!

পরের স্টেশানে নেমে উলটো দিকের ট্রেন ধরে ফেরত এল সে। কিন্তু বাড়ির দিকে না এগিয়ে চলল স্কুল ছাড়িয়ে চড়কপাড়ার ওপাশটায়। মা কাল রাতে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছে, বাস্তব ডাক্তার (মা বোধহয় ডাক্তারবাবুর টাইটেলকে নাম ভেবেছিল) বলে দিয়েছেন, ঘরে কোনও লোমওলা জীব ঢোকানো চলবে না। ও তো মেয়ে-বেড়াল, আর একটু বড় হলেই ছ’মাস অন্তর সংসার বাড়তে থাকবে। তার চেয়ে এখনই পার কর।

জোড়াবটতলা পৌঁছে দেখা গেল, মোড়ের মাথায় চায়ের দোকানগুলো জমজমাট, কিন্তু আগের কাঁচা রাস্তাটার অনেকখানিতে আলো নেই, ভুতুড়ে মতো। সেই ঘুপচি অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে ঢুকে থলে থেকে যেই নামিয়েছে কিশমিশকে, ওমনি গায়ে কোত্থেকে টর্চের আলো --- “অ্যাই, ওটা কী হচ্ছে?” মোটা মতো লোকটা, গায়ে ভুরভুর করছে কঠিন বডি লোশানের গন্ধ, পুক্কার ঘাড়েই এসে পড়ে প্রায়। “এ-পাড়ায় অলরেডি ছেচল্লিশটা আছে। আমি নয়ন মুখার্জি, ক্ল্যাসিকাল সিঙ্গার, আমার কাছে পাকা খবর, এই পোষ মাসেই আমরা হাফ সেঞ্চুরি ক্রশ করে যাচ্ছি। কিন্তু বে-আইনি ভাবে তো জনসংখ্যা বাড়াতে দেব না, ওস্তাদ! পাসপোর্ট নেই, ভিসা নেই, মানে পিয়োর অনুপ্রবেশ। যাও, তুলে নিয়ে চলে যাও।“

বাবাও একদিন গল্প করছিল, ওদের ছোটবেলায় বাড়িতে ছিল চার চারটে মেনি। তাদের বাচ্চাগুলো দুধ ছাড়া মাত্র বাবার ঠাম্মা এই রকম থলেতে পুরেই সন্ধের মুখে অন্য পাড়ায় ছেড়ে দিয়ে আসত। আবার অন্য পাড়া থেকেও তাদের গুড়গুড়িরা একই ফরমুলায় চালান আসত এখানে। অর্থাৎ এক গ্রামের বেড়াল অন্য গ্রামে মানুষ হচ্ছে। তবে আর লাভ কী হল? লাভ হল, বাবা একটু মজার হাসি হাসবে --- শক্তির নিত্যতা সূত্রের!

কিন্তু ছেলেরও নাকি পরে বাবার এই অসুখটা ধরার সম্ভাবনা থেকে যায়, ডক্টর শ্রীবাস্তব বলেছেন। মার খুব ভয় বেড়েছে তাতে। পুক্কার অবাক লাগে। ছোট্ট, সুন্দর পুঁচকিটা, যার বাঁ কান মিশমিশ কালো আর প্রায় সারা গা কালচে বাদামি বলেই নামকরণের সার্থকতা, যে কাল সন্ধেরাতের ঘুম পর্যন্ত তার কোলের মধ্যেই দিল, সেই হবে ওর শ্বাসকষ্টের কারণ!

আর একটা হিসেবেও পুক্কার ভুল হয়েছিল। শুরুতেই ওর যাওয়া উচিত ছিল চাষিপাড়ার দিকটায়, ধরো, ইসুবাটি কি কালিয়ানই। ওদিককার লোকজন সন্ধে একটু ডাগর হলেই খাওয়া-দাওয়া সারে, খুব ভোরে উঠে মাঠ নিড়োতে যেতে হবে না? অনেকটা হেঁটে যশোর রোড, তেঁতুলতলার ব্রিজ পার হয়ে পুক্কা এসে ঢুকল ইসুবাটির মুখে। তারপর, একটা ঘনমতো বাঁশবাগান দেখে থলে উপুড়।

ফিরে আসার রাস্তায় নিজের পাদুটো আর টানতে পারছে না পুক্কাকে। কিশমিশ কী করছে এখন অচেনা নিঃঝুম গাছপালার অন্ধকারে? মিউ মিউ ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়, গা ঘেঁষে ধমক দেওয়ার শব্দে দৌড়ে যাচ্ছে বাইক কিম্বা অটো? হয়তো আশ-পাশের কুকুরের দল সারারাত ওকে তাড়া করে মেরে ফেলতে চাইবে আর কাল সকালে স্কুলের বাচ্চাদের হাতের টিপ প্র্যাকটিস! কেন সে কিশমিশকে বাড়িতেই রাখল না? না হয় ঘরে ঢুকতে দিত না, ছুঁতোই না, শুধু খাবার বেড়ে দেওয়া কলতলার চাতালে। অন্তত বেঁচে তো থাকত চোখের সামনে আর তারা নিজেরাও থেকে যেত সুস্থ। কত বড় জহ্লাদের মতো সে তাকে এক চরম বিপদে ফেলে দিয়ে চলে এসেছে।

মৈত্রী সংঘ পার হয়ে আর একটা মোটে বাঁক, তার পরই নিজের পাড়ায় ঢুকে যাবে। হঠাৎ...আরে, সামনে ওটা কী...কে ওটা...কিশমিশ না! সেই পেছনের ডান পায়ে প্লাস্টারই তো, গোটা চকলেট চেহারায় একটামাত্র পা সাদা বলে যেমন মনে হয়ে থাকে। পুক্কা ছুট্টে গিয়ে কোলে তুলে নিয়েছে---কীভাবে ঠিক চিনে এলি তুই এতদূর থেকে, আমি তো খেয়ালই...চল চল, মাকে সব বুঝিয়ে বলব। কিন্তু কিশমিশ একটু যেন ছটফট করছে কোলের মধ্যে, ওহ নামবি, হিসু করবি, তাই? পুক্কা ওকে নামিয়ে দিচ্ছে মাটিতে। আর তক্ষুনি সেই বেড়াল লাফ দিয়ে উঠে গেল --- পাশে চণ্ডীবাবুস্যারের বাগানঘেরা বাড়ি --- তার পাঁচিলে। তখন অর্ধেক চাঁদ মাথার ওপর ঝুলন্ত, জ্যোৎস্নায় চারপাশ দুধের মতো মসৃণ। আর পাঁচিল থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ভীষণ এক অচেনা চোখে তাকিয়ে আছে কিশমিশ! থতমত খেয়ে যেই অল্প একটু হাত বাড়াবে সে, মুহূর্তের মধ্যে লাফ দিল ওই অতোটা উঁচু থেকে, বাগানের মধ্যে। কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না পুক্কা। অপেক্ষা করল, তারপর ডাক দিল, কোথায় গেলি, ফিরে আয় লক্ষ্মীটি, তোকে আর ফেলে আসব না, সত্যি বলছি। ডাকতে ডাকতে তার গলা বসে যাচ্ছে, বাতাসে সদ্য নামা হিমের নিচে কেমন ভিজে যাচ্ছে কথাগুলো।

চাঁদের আলো ঠিকরনো বাগানের কলাপাতা শুধু মাথা নাড়ছিল --- না, না, না...।


(আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত)

No comments:

Post a Comment