হারু সমঝদার/চন্দন ভট্টাচার্য
বীরশিবপুরের হারু সমাজদার লেখা-পড়াটা শিখতে পারলে
ফেমাস লেখক হতো। কারণ তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা। ব্যর্থ অভিজ্ঞতা বলাই ঠিক হবে। আমাদের
দেশে সবাই কোনও বাচ্চা ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলে প্রথমে শুধোয়, কী পড়? আর, বড় কারও
সঙ্গে আলাপ হলে, কর কী? তা, ছোটবেলায় হারুকে কেউ প্রশ্ন করলে ততক্ষণাত জবাব পেত,
পড়ি না তো! কাজে আছি। “এটুকু বয়েসে কাজ?” ব্যাস, প্রশ্নকর্তা এবার হারুর হাতের
মুঠোয়। “ধরুন, বুধবার সকালে উঠে জিরাট-এর হাটে চলে গেলাম। ওখানে সরষে খুব সস্তা,
এক মণ হাজার টাকার মধ্যে।“
“জিরাফ আজকাল সরষে বিক্রি করছে নাকি?” সে-লোক হয়তো কানে
খাটো, অথবা, হারুর পাকা ব্যবসায়ি হাবভাব দেখে তার মাথা গুলিয়ে গেছে। আমল না দিয়ে
হারু এগিয়ে যায়, “এক মণ সরষে ঘানিতে ভাঙিয়ে আপনি পাচ্ছেন বিশ লিটার তেল। মার্কেটে
সরষে তেলের লিটার আশি টাকা ধরলে আশি ইনটু কুড়ি, ষোলো শো। তার মানে সব খরচাপাতি বাদ
দিয়ে আপনার হাতে নিট পাঁচশো টাকা থেকে গেল!”
এই হারুর বড় হয়ে টাটা-আম্বানিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা,
গেলও তাই। সাফল্যে না হোক, অভিজ্ঞতায়। সেদিন পাড়ার বিশেমামা জানতে চেয়েছিল, হারান
আজকাল কী নিয়ে ব্যস্ত। হারু সিদ্ধিবাবার মতো আধখানা হেসে জবাব দেয়, “আজ আর কালের
মধ্যে অনেক তফাত, মামা। কাল দোকানে দোকানে কেক সাপ্লাইয়ের বিজনেসে ছিলাম, আজ
মেশিনে উলের সোয়েটার তৈরি করছি। আগামি কাল হয়তো অন্য কিছুতে চলে যাব।“
তা, হারুর এই হাজারগন্ডা আধ-খ্যাঁচড়া ব্যবসার ধাক্কা
সামলায় কে? কে আবার, একমাত্র পিসেমশাই পতিতপাবন জোয়ারদার। পতিতবাবুর দুখানা ট্রাক
হাওড়া-দুর্গাপুর লাইন-এ দৌড়ঝাঁপ করছে, তারপর বীরশিবপুরে তার বিউটি পার্লার, ওষুধের
দোকান, শাড়ি-কাপড়ের শোরুম, কী নেই! এ-হেন পতিতপাবনের কী উচিত ছিল? ভোরবেলা উঠে
প্রাণায়াম, যোগব্যায়াম ক’রে ব্লাড সুগার আর থাইরয়েডের অসুখটা কন্ট্রোলে রাখা তো?
অথচ, প্রায় প্রতিদিন তাকে বিছানায় মটকা মেরে পড়ে থাকতে হয়, যতক্ষণ না বৌয়ের আদরের
ভাইপোর ডান হাতটি মুঠো হচ্ছে। ঘটনা এই রকমঃ প্রথমে জানলায় খুব আস্তে তিনটে টোকা
পড়বে, তারপর আধো-অন্ধকারে ওই রোগা সরু-মতো হাত ভেতরে ঢুকে আসবে গরাদের ফাঁক গ’লে।
এবার সেই হাত আঙুল তুলে দেখায়, আজ ঠিক কত দরকার। গত পরশু সকালে যেমন দেখিয়েছিল
পুরো এক পাঞ্জা। অমনি পতিতের বউ বিলাসীবালা পাঁচটা কড়কড়ে একশো টাকার নোট গুঁজে দিল
হারুচরণের হাতে। ব্যাস, হারুর হাত মুঠো মানে অপারেশন শেষ। ডান-চোখে ঘুমিয়ে
বাঁ-চোখটি খুলে এসব দৃশ্য দেখে আসছে পতিতপাবন জোয়ারদার সেই কবে থেকে। তার ঘুম
সেদ্ধ-ডিমের খোলার মতো। কোনওদিন জানলার টোকায় বিলাসী না জেগে উঠলে নিজেই
গলা-খাঁখারি দিয়ে বউকে তুলে দেয়। তবে, পিসিও যে সবসময় ভাইপোকে লাই দিয়ে মাথায়
তুলছে, এমন ভাবলে ভুল হবে। গত মাসে এক রোববার
ভোরে যেমন সে হারুকে ফিসফিস ক’রে বোঝাচ্ছিল, “পিসা-র পাঞ্জাবির পকেটগুলোর
অবস্থা খুব ভালো দেখছি না। একটু বুঝেশুনে চলো, বাবা।“ তখন পতিতপাবনের মনে পড়ে, তিন
নম্বর ট্রাকটা বুক করবে ব’লে ব্যবসা থেকে প্রতিদিনের রোজগারের টাকা সে ব্যাঙ্কে
ফেলে আসছে। আর এদিকে বিলাসির ধারণা সে গরীব হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই লজ্জায় জিভ
কেটে ফেলেছিল মানুষটা!
তা, হারু কোনও বিজনেসেই সুবিধে করতে পারে না কেন? এও
কঠিন প্রশ্ন। তবে পিসি উত্তরটা জানেঃ “আমার হারান খুব শান্ত প্রকৃতির। ধার-বাকির
ঝুট-ঝামেলায় থাকতে চায় না।“ তাই সে সারা মাস বাড়ি বাড়ি কাগজ দিয়ে মাসের শেষে টাকা
কালেকশান করতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ফচা-কে পাঠাত। ফচা লাইন থেকে টাকাপয়সা তুলে নিয়ে
তিনমাসের মাথায় স্টেশনে হারুর দোকানের পাশেই বেঞ্চি পেতে বসে গেছে।
খবরের কাগজের দোকান ফেল মারার পর পতিতপাবন আবার
বলেছিল, তুই ব্যবসার চিন্তা ছেড়ে আমার কোনও একটা গদির ম্যানেজারি কর। কিন্তু
হারুচরণের সাফ কথা, দশটা-পাঁচটার বাঁধা ডিউটি করার জন্যে ভগবান এই সমঝদারকে তৈরি
করেনি। মুড ভালো থাকলে সে জিভের হালকা মোচড়ে নিজের টাইটেলটা একটু পালটে নেয়। অথচ,
হারুর বাবা গুরু সমাজদার চাকরি করত বোলপুরের কাস্টমস অফিসে। একখানা বাস চালিয়ে
প্রতিদিন কর্মচারিদের সকালে নিয়ে আসত অফিসে, আর সন্ধেয় বাড়ি পৌঁছে দিত।
ধীরস্থিরভাবে বাস চালানোর জন্যে সে এলাকায় বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিল। রাস্তায় পেছন থেকে রিকশা, সাইকেল, ঠ্যালাগাড়ি,
যে-ই আওয়াজ দিক, গুরু ওমনি বাস ডানদিকে দাঁড় করিয়ে তাকে সাইড দিয়ে দেবে। পতিত এবার
হারুকে ড্রাইভিং শেখার স্কুলে ভর্তি করে দিল। যদি বাবার এলেম এক-আধটু পেয়ে যায়।
হারুও তাতে মহাখুশি, এও এক আলাদা অভিজ্ঞতা কিনা! গাড়ি চালানো শেখা হলে বড় সাহেবকে
ধরে তাকে ড্রাইভারের অস্থায়ি চাকরিতে ঢুকিয়েও দিল পতিত। হারু পিসির বুক শ্মশান করে
দিয়ে গেদে সীমান্তে চলে গেল।
ও মা, ছ’মাস
গেছে কি যায়নি, ছেলেটা আবার এক-গাল হাসি সুদ্ধু বীরশিবপুরে ফেরত। কানাঘুষোয় শোনা
যাচ্ছে, কানে কম শুনছিল সে। কাস্টমস-এ তো চোরাকারবারি ধরার কাজ। ধরো, হারুর জিপ
তাড়া করেছে স্মাগলারের গাড়ি। হিন্দি সিনেমার স্টাইলে খুব জোর টক্কর, হারু অপরাধীকে
পাকড়ে ফেলে আর কি! পাশে বসা ও.সি. একটু উতসাহ দেওয়ার জন্যে যেই বলেছেন, “বাহ,
ফাটাফাটি চেজ করছ হারাধন”, অমনি হারু “কী বললেন স্যার” ব’লে ঘ্যাঁচ ক’রে ব্রেক
ক’ষে দিল। আর ততক্ষণাত হুস ক’রে নাকে একগাদা ধুলো ছিটিয়ে পগার পার স্মাগলারের
গাড়ি।
ব্যর্থ চাকরি থেকে ফিরে ক’মাসের মাইনের টাকা লাগিয়ে
হারু বাজারে ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান দিয়েছিল। বন্ধুরা পই পই ক’রে মানা করা
সত্বেও দোকানের নাম রেখেছিল নিদ্রা ইলেকট্রিকস। গেদে-য় তার বাসার পাশে একটা
ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ের নাম নাকি ছিল নিদ্রা। ব্যাস, তিন মাসের মধ্যে উঠে গেল সে
দোকান। যে দোকানের নামেই ঘুম, সেখানে আলো খুঁজতে যাবে, লোকের কিমাথা খারাপ হয়েছে!
কাজেই, সকালবেলা
পতিতপাবনের প্রাণায়াম শুরু করতে আবার দেরি। তবে, নতুন আশার কথা হল, হারু এখন
টেলারিং শিখতে উতসাহী। মাস দুয়েক চুপচাপ থাকার পর একদিন সরাসরি ঘরে ঢুকে পিসের ঘুম
ভাঙাল সে, “ভাবছি, চুড়িদার এক্সপোর্ট করবো।“ তন্দ্রার ঝোঁকে পতিত প্রথমে কথাটা
শুনতে পায়নি, “কী বললি, চুরিতে এক্সপার্ট হব? সে তো তোমরা পিসি-ভাইপো...” বিলাসী
তাড়াতাড়ি সামলে নিল, “সব সময় জোকস করা স্বভাব তোমার! শোনো, বিশ হাজার টাকা পেলে
ছেলেটা বড়বাজার থেকে অল্প কিছু কাপড় তুলতে পারে। আমার মনে হয়, দিয়ে দেওয়াই ভালো।“
পতিত তর্কে যায় না। গতকালই সে হারুর মাস্টার, এ-পাড়ার নামকরা দর্জি তুতুলকে জিগেস
করেছিল। তুতুল ঠোঁট উলটে বলেছে, আগে ছ’কাটের শায়া কাটতে শিখুক, তারপর তো চুড়িদার!”
পতিত শুধু মুখে বলে,
ঠিক আছে, আমি কুড়ি হাজার টাকাই দেব। কিন্তু আমেরিকায় চুড়িদার রপ্তানির জন্যে নয়।
জামাকাপড়ের কাটিং যেমন শিখছে শিখুক। হারু একটা ক্যামেরা কিনে আনুক বরং। ছবি তোলা
আমিই দেখিয়ে দিচ্ছি। এখনও গ্রামে বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশনে ক্যামেরাম্যানের ডাক পড়ে।
আয়-পয় মন্দ হবে না।“
ক্যামেরা! তার মানে
নতুন অভিজ্ঞতার দরজা ক্যাঁচ ক’রে আর একবার খুলে যাচ্ছে হারু সমাজদারের সামনে। পতিত
নিজের হাতে অ্যাপারচার, এক্সপোজার সব বুঝিয়ে দিয়ে বলল, ছবি তোলার আগে জাস্ট জিগেস
করবিঃ রেডি তো? একটু হাসুন দেখি। ব্যাস, শাটার টিপবি সঙ্গে সঙ্গে। তোর ছবি কক্ষনও
মার খাবে না।
না, হারুর
এ-ব্যাবসাও টেঁকেনি। ছবি হয়তো মার খেত না, কিন্তু হারু নিজের পাবলিকের হাতে তুমুল
ঠ্যাঙানি খেয়ে এক সপ্তাহ হাসপাতালে শুয়ে থেকে আজ শুক্কুর-শনি দুদিন হল পিসেমশাইয়ের
জয়দুর্গা শাড়ি এম্পোরিয়ামে জয়েন করেছে।
ঘটনা অতি সামান্য।
সাধুখাঁবাড়ির ঠাকুমা একশো তিন বছর বয়েসে মারা গেলেন। ঠাকুমার নাতি-নাতনির মোট
সংখ্যা --- সেই একবার যে রানে ভারত ইংল্যান্ডের
কাছে অল আউট হয়েছিল --- বেয়াল্লিশ! লোকজনে গমগম করা বাড়িতে হারুকে ডাকা হয়েছে ছবি
তুলতে। বাড়ির ফুল-কর্তা বলে গেল, “প্রথমে মায়ের একার একখানা ছবি তোল হারানিধি,
বৈঠকখানা ঘরে বড় ক’রে বাঁধিয়ে রাখা হবে।“
ঘটনা এইটুকুই। হারু সমঝদার ক্যামেরা জায়গা-মতো সেট ক’রে শাটার টেপার আগে
অভিজ্ঞ ক্যামেরাম্যানের মতো শুধু বলেছিল, “রেডি?” তারপর জবাবের জন্যে একটু অপেক্ষা
ক’রে, “স্মাইল প্লিজ!”