Saturday 13 September 2014

হারু সমঝদার (ছোটোদের গল্প)

হারু সমঝদার/চন্দন ভট্টাচার্য

বীরশিবপুরের হারু সমাজদার লেখা-পড়াটা শিখতে পারলে ফেমাস লেখক হতো। কারণ তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা। ব্যর্থ অভিজ্ঞতা বলাই ঠিক হবে। আমাদের দেশে সবাই কোনও বাচ্চা ছেলের সঙ্গে পরিচয় হলে প্রথমে শুধোয়, কী পড়? আর, বড় কারও সঙ্গে আলাপ হলে, কর কী? তা, ছোটবেলায় হারুকে কেউ প্রশ্ন করলে ততক্ষণাত জবাব পেত, পড়ি না তো! কাজে আছি। “এটুকু বয়েসে কাজ?” ব্যাস, প্রশ্নকর্তা এবার হারুর হাতের মুঠোয়। “ধরুন, বুধবার সকালে উঠে জিরাট-এর হাটে চলে গেলাম। ওখানে সরষে খুব সস্তা, এক মণ হাজার টাকার মধ্যে।“

“জিরাফ আজকাল সরষে বিক্রি করছে নাকি?” সে-লোক হয়তো কানে খাটো, অথবা, হারুর পাকা ব্যবসায়ি হাবভাব দেখে তার মাথা গুলিয়ে গেছে। আমল না দিয়ে হারু এগিয়ে যায়, “এক মণ সরষে ঘানিতে ভাঙিয়ে আপনি পাচ্ছেন বিশ লিটার তেল। মার্কেটে সরষে তেলের লিটার আশি টাকা ধরলে আশি ইনটু কুড়ি, ষোলো শো। তার মানে সব খরচাপাতি বাদ দিয়ে আপনার হাতে নিট পাঁচশো টাকা থেকে গেল!”

এই হারুর বড় হয়ে টাটা-আম্বানিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা, গেলও তাই। সাফল্যে না হোক, অভিজ্ঞতায়। সেদিন পাড়ার বিশেমামা জানতে চেয়েছিল, হারান আজকাল কী নিয়ে ব্যস্ত। হারু সিদ্ধিবাবার মতো আধখানা হেসে জবাব দেয়, “আজ আর কালের মধ্যে অনেক তফাত, মামা। কাল দোকানে দোকানে কেক সাপ্লাইয়ের বিজনেসে ছিলাম, আজ মেশিনে উলের সোয়েটার তৈরি করছি। আগামি কাল হয়তো অন্য কিছুতে চলে যাব।“

তা, হারুর এই হাজারগন্ডা আধ-খ্যাঁচড়া ব্যবসার ধাক্কা সামলায় কে? কে আবার, একমাত্র পিসেমশাই পতিতপাবন জোয়ারদার। পতিতবাবুর দুখানা ট্রাক হাওড়া-দুর্গাপুর লাইন-এ দৌড়ঝাঁপ করছে, তারপর বীরশিবপুরে তার বিউটি পার্লার, ওষুধের দোকান, শাড়ি-কাপড়ের শোরুম, কী নেই! এ-হেন পতিতপাবনের কী উচিত ছিল? ভোরবেলা উঠে প্রাণায়াম, যোগব্যায়াম ক’রে ব্লাড সুগার আর থাইরয়েডের অসুখটা কন্ট্রোলে রাখা তো? অথচ, প্রায় প্রতিদিন তাকে বিছানায় মটকা মেরে পড়ে থাকতে হয়, যতক্ষণ না বৌয়ের আদরের ভাইপোর ডান হাতটি মুঠো হচ্ছে। ঘটনা এই রকমঃ প্রথমে জানলায় খুব আস্তে তিনটে টোকা পড়বে, তারপর আধো-অন্ধকারে ওই রোগা সরু-মতো হাত ভেতরে ঢুকে আসবে গরাদের ফাঁক গ’লে। এবার সেই হাত আঙুল তুলে দেখায়, আজ ঠিক কত দরকার। গত পরশু সকালে যেমন দেখিয়েছিল পুরো এক পাঞ্জা। অমনি পতিতের বউ বিলাসীবালা পাঁচটা কড়কড়ে একশো টাকার নোট গুঁজে দিল হারুচরণের হাতে। ব্যাস, হারুর হাত মুঠো মানে অপারেশন শেষ। ডান-চোখে ঘুমিয়ে বাঁ-চোখটি খুলে এসব দৃশ্য দেখে আসছে পতিতপাবন জোয়ারদার সেই কবে থেকে। তার ঘুম সেদ্ধ-ডিমের খোলার মতো। কোনওদিন জানলার টোকায় বিলাসী না জেগে উঠলে নিজেই গলা-খাঁখারি দিয়ে বউকে তুলে দেয়। তবে, পিসিও যে সবসময় ভাইপোকে লাই দিয়ে মাথায় তুলছে, এমন ভাবলে ভুল হবে। গত মাসে এক রোববার  ভোরে যেমন সে হারুকে ফিসফিস ক’রে বোঝাচ্ছিল, “পিসা-র পাঞ্জাবির পকেটগুলোর অবস্থা খুব ভালো দেখছি না। একটু বুঝেশুনে চলো, বাবা।“ তখন পতিতপাবনের মনে পড়ে, তিন নম্বর ট্রাকটা বুক করবে ব’লে ব্যবসা থেকে প্রতিদিনের রোজগারের টাকা সে ব্যাঙ্কে ফেলে আসছে। আর এদিকে বিলাসির ধারণা সে গরীব হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই লজ্জায় জিভ কেটে ফেলেছিল মানুষটা!

তা, হারু কোনও বিজনেসেই সুবিধে করতে পারে না কেন? এও কঠিন প্রশ্ন। তবে পিসি উত্তরটা জানেঃ “আমার হারান খুব শান্ত প্রকৃতির। ধার-বাকির ঝুট-ঝামেলায় থাকতে চায় না।“ তাই সে সারা মাস বাড়ি বাড়ি কাগজ দিয়ে মাসের শেষে টাকা কালেকশান করতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ফচা-কে পাঠাত। ফচা লাইন থেকে টাকাপয়সা তুলে নিয়ে তিনমাসের মাথায় স্টেশনে হারুর দোকানের পাশেই বেঞ্চি পেতে বসে গেছে।

খবরের কাগজের দোকান ফেল মারার পর পতিতপাবন আবার বলেছিল, তুই ব্যবসার চিন্তা ছেড়ে আমার কোনও একটা গদির ম্যানেজারি কর। কিন্তু হারুচরণের সাফ কথা, দশটা-পাঁচটার বাঁধা ডিউটি করার জন্যে ভগবান এই সমঝদারকে তৈরি করেনি। মুড ভালো থাকলে সে জিভের হালকা মোচড়ে নিজের টাইটেলটা একটু পালটে নেয়। অথচ, হারুর বাবা গুরু সমাজদার চাকরি করত বোলপুরের কাস্টমস অফিসে। একখানা বাস চালিয়ে প্রতিদিন কর্মচারিদের সকালে নিয়ে আসত অফিসে, আর সন্ধেয় বাড়ি পৌঁছে দিত। ধীরস্থিরভাবে বাস চালানোর জন্যে সে এলাকায় বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিল। রাস্তায় পেছন থেকে রিকশা, সাইকেল, ঠ্যালাগাড়ি, যে-ই আওয়াজ দিক, গুরু ওমনি বাস ডানদিকে দাঁড় করিয়ে তাকে সাইড দিয়ে দেবে। পতিত এবার হারুকে ড্রাইভিং শেখার স্কুলে ভর্তি করে দিল। যদি বাবার এলেম এক-আধটু পেয়ে যায়। হারুও তাতে মহাখুশি, এও এক আলাদা অভিজ্ঞতা কিনা! গাড়ি চালানো শেখা হলে বড় সাহেবকে ধরে তাকে ড্রাইভারের অস্থায়ি চাকরিতে ঢুকিয়েও দিল পতিত। হারু পিসির বুক শ্মশান করে দিয়ে গেদে সীমান্তে চলে গেল।

  ও মা, ছ’মাস গেছে কি যায়নি, ছেলেটা আবার এক-গাল হাসি সুদ্ধু বীরশিবপুরে ফেরত। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, কানে কম শুনছিল সে। কাস্টমস-এ তো চোরাকারবারি ধরার কাজ। ধরো, হারুর জিপ তাড়া করেছে স্মাগলারের গাড়ি। হিন্দি সিনেমার স্টাইলে খুব জোর টক্কর, হারু অপরাধীকে পাকড়ে ফেলে আর কি! পাশে বসা ও.সি. একটু উতসাহ দেওয়ার জন্যে যেই বলেছেন, “বাহ, ফাটাফাটি চেজ করছ হারাধন”, অমনি হারু “কী বললেন স্যার” ব’লে ঘ্যাঁচ ক’রে ব্রেক ক’ষে দিল। আর ততক্ষণাত হুস ক’রে নাকে একগাদা ধুলো ছিটিয়ে পগার পার স্মাগলারের গাড়ি।

ব্যর্থ চাকরি থেকে ফিরে ক’মাসের মাইনের টাকা লাগিয়ে হারু বাজারে ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান দিয়েছিল। বন্ধুরা পই পই ক’রে মানা করা সত্বেও দোকানের নাম রেখেছিল নিদ্রা ইলেকট্রিকস। গেদে-য় তার বাসার পাশে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ের নাম নাকি ছিল নিদ্রা। ব্যাস, তিন মাসের মধ্যে উঠে গেল সে দোকান। যে দোকানের নামেই ঘুম, সেখানে আলো খুঁজতে যাবে, লোকের কিমাথা খারাপ হয়েছে!

কাজেই, সকালবেলা পতিতপাবনের প্রাণায়াম শুরু করতে আবার দেরি। তবে, নতুন আশার কথা হল, হারু এখন টেলারিং শিখতে উতসাহী। মাস দুয়েক চুপচাপ থাকার পর একদিন সরাসরি ঘরে ঢুকে পিসের ঘুম ভাঙাল সে, “ভাবছি, চুড়িদার এক্সপোর্ট করবো।“ তন্দ্রার ঝোঁকে পতিত প্রথমে কথাটা শুনতে পায়নি, “কী বললি, চুরিতে এক্সপার্ট হব? সে তো তোমরা পিসি-ভাইপো...” বিলাসী তাড়াতাড়ি সামলে নিল, “সব সময় জোকস করা স্বভাব তোমার! শোনো, বিশ হাজার টাকা পেলে ছেলেটা বড়বাজার থেকে অল্প কিছু কাপড় তুলতে পারে। আমার মনে হয়, দিয়ে দেওয়াই ভালো।“ পতিত তর্কে যায় না। গতকালই সে হারুর মাস্টার, এ-পাড়ার নামকরা দর্জি তুতুলকে জিগেস করেছিল। তুতুল ঠোঁট উলটে বলেছে, আগে ছ’কাটের শায়া কাটতে শিখুক, তারপর তো চুড়িদার!”

পতিত শুধু মুখে বলে, ঠিক আছে, আমি কুড়ি হাজার টাকাই দেব। কিন্তু আমেরিকায় চুড়িদার রপ্তানির জন্যে নয়। জামাকাপড়ের কাটিং যেমন শিখছে শিখুক। হারু একটা ক্যামেরা কিনে আনুক বরং। ছবি তোলা আমিই দেখিয়ে দিচ্ছি। এখনও গ্রামে বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশনে ক্যামেরাম্যানের ডাক পড়ে। আয়-পয় মন্দ হবে না।“

ক্যামেরা! তার মানে নতুন অভিজ্ঞতার দরজা ক্যাঁচ ক’রে আর একবার খুলে যাচ্ছে হারু সমাজদারের সামনে। পতিত নিজের হাতে অ্যাপারচার, এক্সপোজার সব বুঝিয়ে দিয়ে বলল, ছবি তোলার আগে জাস্ট জিগেস করবিঃ রেডি তো? একটু হাসুন দেখি। ব্যাস, শাটার টিপবি সঙ্গে সঙ্গে। তোর ছবি কক্ষনও মার খাবে না।

না, হারুর এ-ব্যাবসাও টেঁকেনি। ছবি হয়তো মার খেত না, কিন্তু হারু নিজের পাবলিকের হাতে তুমুল ঠ্যাঙানি খেয়ে এক সপ্তাহ হাসপাতালে শুয়ে থেকে আজ শুক্কুর-শনি দুদিন হল পিসেমশাইয়ের জয়দুর্গা শাড়ি এম্পোরিয়ামে জয়েন করেছে।
ঘটনা অতি সামান্য।

সাধুখাঁবাড়ির ঠাকুমা একশো তিন বছর বয়েসে মারা গেলেন। ঠাকুমার নাতি-নাতনির মোট সংখ্যা --- সেই একবার যে  রানে ভারত ইংল্যান্ডের কাছে অল আউট হয়েছিল --- বেয়াল্লিশ! লোকজনে গমগম করা বাড়িতে হারুকে ডাকা হয়েছে ছবি তুলতে। বাড়ির ফুল-কর্তা বলে গেল, “প্রথমে মায়ের একার একখানা ছবি তোল হারানিধি, বৈঠকখানা ঘরে বড় ক’রে বাঁধিয়ে রাখা হবে।“

ঘটনা এইটুকুই। হারু সমঝদার ক্যামেরা জায়গা-মতো সেট ক’রে শাটার টেপার আগে অভিজ্ঞ ক্যামেরাম্যানের মতো শুধু বলেছিল, “রেডি?” তারপর জবাবের জন্যে একটু অপেক্ষা ক’রে, “স্মাইল প্লিজ!”

Sunday 24 August 2014

লাভা-র বয়

লাভা- বয়
এক
তুমি আমাকে বলেছ, লেখো, লেখোই না! সারাদিন এতো যে বকবক 'রে আমার কানের পোকা নড়িয়ে দাও, তা শুধু একাই কষ্ট পাবো কেন? দু-পাঁচশো লোক অন্তত বুঝুক কী গেরো আমার!

বৃষ্টি হচ্ছে, তবে আসি-যাই-মাইনে-পাই ধরণের দায়সারা বর্ষণ ধরো, তবলায়  "তেরেকেটেতাক তেরেকেটে" যেমন মেরেকেটে হালকা প্র্যাক্টিস একটা এদিক-সেদিক কাঠ-খোলা ঝোলানো ব্রিজের ওপর 'সে আছি নিচে বোল্ডারে জলধাক্কার রাগিনী শোনানো চেল নদী, স্থানের নাম গরুবাথান সেখানে কষ্ট-কষ্ট মুখ 'রে বসা আমি মনের কানে শুনলাম, তুমি এবার আঙুল তুলে শাসাচ্ছো --- লিখবে কিনা!

এখান থেকেই রাস্তা তার পিঠ সোজা 'রে দুপাশের পাইন-জঙ্গলকে ইন্সপায়ার 'রল, চল চল পাহাড়ে উঠি যেন রাখাল গরুর পাল 'য়ে যায় মাঠে এবং লাভা- উঠেও পথ যদি শেষ না হয়, কেউ কেউ সেই "চু" 'রে একই দমে কালিম্পং! তোমার সঙ্গে ঝগড়া 'রে অল্প কিছু কারেন্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম, ট্রেকার ছাড়বে বিশ সাল বাদ বিশ বোলে তো তিন ঘন্টা আগাম সিট বুকিং আমার পকেটে --- পঞ্চাশ টাকা পঞ্চাশ টাকা পঞ্চাশ টাকা  উত্তর কলকাতার বনেদি চালে একবার ভাড়ার প্রাইভেট কারের গায়ে হাত রাখতে গেছিলাম, কারেন্ট খেয়ে পালিয়েছি ভাড়া আটশো ওনলি, আপনার কথা-বার্তা ভালো লেগেছে 'লে একশো নামিয়ে দিলাম নিকুচি 'রেছে ভালো লাগার!

কত রকম দোকান গরুবাথানের ছোট্ট বাজার এলাকায়! তার কোনও একটিতে গিয়ে দাঁড়ালেই হাতে কার্ড ধরিয়ে দিচ্ছে --- লাভা যাবেন কি? এই মোবাইল নাম্বারে ফোন করলে আমারই ভাই, সস্তায় ভালো হো...  খাতার বদলে ছাতা নিয়ে ঘুরছিলাম, বৃষ্টিতে মাথা বাঁচানোর কাজে এর অভিজ্ঞতাও কিছু ফ্যালনা নয়! তাছাড়া, কখন শ্রাবণধারার সঙ্গে মিশে দু-একটা কবিতার লাইন 'রে পড়বে, আমি আগেকার দিনের ক্যামেরাম্যানের মতো কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে রাখলে দেখব কী 'রে? তো, সেই খাতা দোকানের বেঞ্চে ফেলে উঠে গেছিলাম মনে পড়তে দৌড়ে গিয়ে দেখি, একটা ছেলে 'সে পাতা ওলটাচ্ছে সর্বনাশ! সরল-সাদা পাহাড়ি ছেলের হাতে শিক্ষিত-আঁতেল-যন্তরপিস বাঙালির আধুনিক কবিতা? ততক্ষণাত ঝঁপিয়ে পড়ে কেড়ে নিয়েছি আমি  পরিবেশ-দূষণের প্রচণ্ড বিরুদ্ধে!

শিলিগুড়ি থেকে যখন -পথে আসি, দীর্ঘদিনের বন্ধু রঞ্জিত দত্ত বলেছিল, "পাহাড়ে নেপালি, লেপচা বা ভুটিয়ারা যত সহজে বসতি করতে পারে, বাঙালি সেটা কখনই পারবে না আমরা সমতলের প্রাণী" ট্রেকারে 'সে পথের দুপাশে তাকিয়ে দত্তদার বাণীর সমর্থন পাচ্ছিলাম শুনশান রাস্তার বাঁদিক 'রে নেমে আসছেন যে মানুষটি, মাথায় সবুজ লতা-পাতার বোঝা- তাকে লাগছে দু'পাওলা চলন্ত বাগান এবং মনে রাখতে হবে, বর্ষা এখন বোল পালটে "দেন দেন গদি ঘেনে ধা ক্রান"! সমুদ্রগভীর এক থমথমে বাজনা উঠে আসছ এই ঋতুর সর্ব-গা থেকে আর বাকলে  বহু-চির দাগ নিয়ে নানা পোকা-মাকড়ের আশ্রয়, পুরনোস্য পুরনো... পাইন আমার প্রিয় পাইন! এমন গাঁজানো ঠাসা চুল তার মাথায়, বলতে লোভ হ’ল, “ভালুক-পাইন”! যেন মোটা লম্বা গুঁড়ির মাথায় চ’ড়ে ব’সে আছে পশম-র্তি বিয়ারশিশু।
নাহ, ফিরে গিয়ে এসব গল্প তোমার সামনে একবারও নয়! তা হ’লেই তো সেই জ্ঞান ফলাবে, লিখে ফ্যালো। আজ বরং রিহার্সালটা সেরে নিই, যখন তোমাকে সঙ্গে আনব (আনব তো জীবনে একবার নিশ্চয়ই), সেই ফাইনাল টেক-এর সময়ে কী কী দেখাব গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে, কোন কোন স্পটে একজন প্রকৃত দেবানন্দের .....স্যরি, একজন  সত্যিকারের গাইডের মতো দাঁড়িয়ে তোমাকে বোঝাবো নেওড়া ভ্যালি ফরেস্টের অন্ধি-সন্ধি।  

দুই
ভাবতে ভাবতে দুঘন্টায় লাভা। মনে হল, ঘুমা-ফিরা-কে সেই “ঘুম”ই বুঝি আমার চোখের সামনে। এত কুয়াশার ঘরবাড়ি চারদিকে, এবং দেখা যাচ্ছে, এখানকার অধিবাসীবৃন্দের নিঃশ্বাস নিতে অক্সিজেন লাগে না, মুখ আচমনে জল লাগে না, খেতেও দরকার পড়ে না চাওমিন বা স্যান্ডউইচ। শুধু এক ঢোঁক মজবুত আর টিঁকাও টাটকা কুয়াশা, ব্যাস!

বন্ধু রঞ্জিত দত্তেরই আত্মীয় গৌরাঙ্গ দাসের সঙ্গ করেছি শিলিগুড়িতে। সে এক জঙ্গল-পাগল। ভোরে উঠে হঠাৎ দূরের কোনও নদীর কাছে গিয়ে ব’সে থাকে।  আশ্চর্য সব ফুল আর পাখিতে ভর্তি তার ক্যামেরা। মিষ্টি বউ আর ততোধিক ফুটফুটে মেয়েকে ফেলে মাঝে -মাঝেই নিপাত্তা হ’য়ে যায় গভীর জঙ্গলে বাঘসুমারি করা দলের সঙ্গে। নদীয়ার  নিমাইকে একবারই সংসারের মায়া কাটাতে হয়েছিল সন্ন্যাসী হওয়ার কালে। কিন্তু দেখলাম,  আধুনিক গৌরাঙ্গের টেনাসিটি অনেক বেশি, সে ভরা সংসার জলাঞ্জলি দিয়ে দ্যাখ না দ্যাখ গৃহত্যাগী!

শেষ বিকেলের লাভা-তে হোটেলের গরমে ঢুকে প্রথমে মনে হয়েছিল, এখান থেকে আমাকে টেনে বের করে কার সাধ্যি! তারপর একটু ধাতস্থ হ’য়ে ভাবলাম, যতটা পয়সা উশুল করা যায়! বেরিয়ে পড়া গেল চাদরমুড়ি দিয়েশুনসান রেস্তোরাঁগুলোর দরজায় মেয়েদের বিষন্ন মুখ; কড়া কফি, ধোঁয়া-ওঠা মোমোর প্লেটে তারা অতিথিসেবা করতে চায়। কিন্তু আমি মানুষ যে মোটে একখানা! ক’টা দোকানে খাবারের অর্ডার দিই, বলো? ঘুরে বেড়াতে লাগলাম এদিক-সেদিক, হাওয়ায় শুকনো পাতার মতো। পথের কেউ কেউ জানিয়ে গেল, এখানে ওয়েদার এখন ভালো হবে না গো। তুমি লোলেগাঁও চ’লে যাও কাল সকালে উঠে। কেননা, লাভা-য় সূর্য বন্ধ, রিকোয়েস্ট করলেও উঠছে না। সাইট সিয়িং বাতিল। আবহাওয়া ভালো থাকল তো ট্রেক ক’রে রিশপও যেতে পারতে, এক ঘন্টায় পৌঁছে আবার এক ঘন্টায় ফিরে আসা। এবার সেখানে কতক্ষণ ত্থাকবে, তোমার ব্যাপার। হোটেলে ব’লে দিলে ওরা গাইডও এনে দেয় শ’দেড়েক টাকার মধ্যে। কিন্তু ঘটনা  হ’ল, না-দেখতে পাওয়াটাকেই যদি কেউ দেখতে পায়, তবে আর মুশকিল কোথায়? ধরো, এই যে তোমার সঙ্গে মনোমালিন্য ক’রে  আমি ফাঁচোট (পুরুলিয়ার ভাষা), অথচ সেই থেকে তোমার কথাই আমার কুল কুলকুণ্ডলিনীতে জেগে ব’সে আছে। আমার অটোনমাস নার্ভাস সিস্টেম ঝাউ গাছের ফাঁক দিয়ে ক্যামেরা ফেলে রেখেছে তোমার ওপরেই। তেমনি, আজ হয়তো লাভা আমাকে পাহাড়ের রেঞ্জ দেখাতে পারল না, কিন্তু আমি তার শূন্যতাকে ভ’রে থাকতে দেখলাম জল-মেশানো সাদা মতো একটা বস্তুতে যা আমাদের পাড়ার মানিক সকালবেলা বালতিতে নিয়ে ঘোরে। এবং তাকে যদি বলা যায়, মানিক, আজ এক সের দুধ বেশি দিতে পারবে? মানিকের মুখে তুমি কক্ষণও “না” শুনবে না।  সেরকম শিক্ষাই সে পায়নি। শুধু ব’লবে, এই একটু ঘুরে এসে দিচ্ছি। এবার, কোথায় সে ঘুরতে গেল, পশ্চিমবঙ্গের সব মানিকরা ভোরবেলা কোন জায়গা থেকে টুক ক’রে বেড়িয়ে আসে, আমার তো ধারণাই ছিলো না। যারা সিনিক, বলতেন, দ্যাখো গে যাও, মিউনিসিপ্যালিটির টাইম কলের সামনে মানিকের সাইকেল জিরোন খাচ্ছেমানুষের কতো না ভুল সন্দেহ! আসলে, মানিক-গোয়ালাদের গোডাউন হ’ল লাভা-র বাতাস-ভর্তি দুহাজার টন দুধ-কুয়াশা।

এবার তুমি যদি পাখি হও, যা আমি সত্যি ব’লে জানি, তবে এই কুয়াশা-পাথর বেয়ে ওঠো না, কে বারণ করছে। যদি তুমি গাছ, যে কথাটাও একফোঁটা বাড়িয়ে বলা নয়, তবে স্থায়ি ও নির্ভরযোগ্য এই মেঘের প্যাক মুখ-চোখে এক ঘন্টা লাগিয়ে রেখে তার পর হালকা গোধূলি-আলোর তুলো দিয়ে আস্তে ক’রে মুছে ফেলুন। থাকুন আরামে। বুনো হাতির কাঁধে চেপে যেমন নীলকন্ঠ পাখি ফোকোটিয়া রাস্তা পাড়ি দেয়! হঠাত দত্তদার কথার উত্তরটা মাথায় এল। প্রকৃতির রাজত্বে এসে, যেখানে নিসর্গই “দিল্লিশ্বরো জগদীশ্বরো বা”, তাকে আত্মায় বসিয়ে নিতে না পারলে টিঁকে থাকব কী ক’রে?  পাহাড়ি মানুষেরা তো পাহাড়েরই মিনিবুক চেহারা, অরণ্যের ঘুরে-ফিরে বেড়ানো সংস্করণ। ক’জন বাঙালি সেটা হ’তে পারে?
তিন

সন্ধে নেমে গেছে অনেকক্ষণ। শান্ত হ’য়ে এসেছে লাভা-র দুর্গসম বৌদ্ধমন্দির। হোটেলে ফিরে আসতে আসতে ভাবলাম, কেন আমি ট্যুরিস্ট হব? আমি তোমার গাইড হ’তে চেয়েছি যখন, শহরের লোক যাকে বলে হোস্টাইল ওয়েদার, আমাকে তার মধ্যেই তো থাকতে হবে। গাইড মানেই স্থানীয়। যখন কেউ আসে না এখানে, জীবন প্রতিকূল, তখন কি শিরায় শিরায় টের পাব না, দোকান সাজিয়ে শূন্য ব’সে থাকা মানুষগুলো ঠিক প্লাস্টিকের তারের গায়ে আঁকা রাজারানী? ঠোঁটে এন্তার-সে খৈনি গুঁজে বৃষ্টি-টুপির কানাত চিরে ছুরি-নজর চালানো ভাড়া গাড়ির হেল্পারকে চিনব না, যে গোটা দিনে ডেস্পারেটলি শুধু একটা ট্রিপ চাইছে? আর, আহা, নীল বর্ষাতি ঢাকা ওই স্কুল-কিশোরি! যে-ভঙ্গিতে সে বইয়ের ব্যাগে মুখ ডুবিয়ে হেঁটে গেল, সেটা তো টুকে নিয়েইছি তোমার-আমার নিজস্ব মুহূর্তের জন্যে!

হোটেলে আর ফিরতে ইচ্ছে ক’রল না। রাস্তার দুপাশে ফুলে সাজানো বাড়িঘর। তাদের রঙিন কাচ-বসানো বন্ধ দরজায় আমি মনে মনে টোকা দিতে লাগলাম, পেয়িং গেস্ট রাখবেন আমায়? হ্যাঁ হ্যাঁ, সারা জীবনের জন্যে। তারপর, আস্তে আস্তে যদি হাতে কিছু পয়সা জমাতে পারি, এবং সেটা দারু খেয়ে উড়িয়ে না দিই, তবে এখানেই আশ-পাশে একটা ছোট্ট মকান..... ।

Monday 18 August 2014

“আর ডি” এক্স

“আর ডি” এক্স 
হোয়াইট মার্বেল-এ তৈরি শীতল ও শক্ত --- অতীতের সমস্ত গথিক সৌধকে তুমি রাহুল দ্রাবিড় নামে ডাকতে পারো। যেমন আকাশ থেকে টাঙানো ঝাড়-লন্ঠন, যেমন মিউজিয়ামের দুধ-রঙ অন্তর্দেয়ালগুলো --- কিন্তু রাহুল কি ওই প্রাসাদে ব’সে চতুর্দশ হারেম তার মণিবসানো মণিবন্ধে নাচাতো? না। সে বরং রাজমহলটি বানানোর পর নিজের বুড়ো আঙুলকে টিকটিকির লেজ হয়ে যেতে দেখেছে, যা শরীর-বিচ্ছিন্ন হয়েও লাফাতে ওস্তাদ!

ওপরের স্তবক থেকে দুটো সত্যি পিছলে নেমে আসে। দুর্গের রাজার নাম ভারতীয় ক্রিকেট। আর রাহুলের পক্ষে উত্তরাধিকারী রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। সদ্য নিজের তৈরি কাঁচা রঙের গন্ধ-ওঠা বাড়ির কলিং বেলে যখন হাত রাখে রাজ-মিস্তিরি, তার বডি-ল্যাঙ্গোয়েজ দেখেছ! সিমেন্ট-খসখসে মোটা হাতের চিরুনি দিয়ে মাথার খাড়া কুন্তল সজুত করতে করতে সে বাকি ক’টা টাকার তাগাদায় এসেছে। তার গামছা-চেক লুঙ্গির আভিজাত্যের কাছে বাড়ির মালিকের তিনশো চব্বিশ টাকার হাওয়াই চপ্পলও থিন অ্যারারুট লাগে।

দুই
তাহলে ৯ই মার্চ দু’হাজার বারোতে সৌধ কি স্মৃতিসৌধে বদলে গেল! মোট্টেই না। আর. ডি. চিরকাল এক্স(অতীত)-ই ছিলেন। ব্যাট করতে নামার সময় ক্যামেরায় রাহুলের মুখখানা চোখে পড়েছে আশাকরি। টেস্টের মাঠে মনে হবে, বাবার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে প্যাড আপ করতে হয়েছে, ওয়ান ডে-র দিনে চলতি ধারণাঃ মা এইমাত্র দেহ রাখলেন, আর টি টোয়েন্টি? ছোট ছেলে আই.সি.ইউ.-তে! আধুনিকতম ক্রিকেটের “টিক টোয়েন্টি” সেবন ক’রেও রাহুল যে সুস্থ মাথায় অবসর নেওয়ার দিনক্ষণ মেনে সাংবাদিকদের সামনে বসে পড়েন, এই না কত! কাজেই রাহুল দ্রাবিড় হল কবর থেকে ওঠা এক ক্ল্যাসিকাল ভূতের নাম। অথবা, মহেঞ্জোদরোর বাঁহাতে কনুই ইস্তক বালা-পরা নগ্নিকার পুরুষ রেপ্লিকা। বিশ্ব ক্রিকেটে তিনি টাইম মেশিনে চেপে দুটো অধ্যায় পেছন থেকে লাফিয়ে এসে বসেছেন। এখন ব্যাটে-বলে ধোনি-যুবরাজ-পাঠান যেন ইন্দ্রিয়াসক্ত সৌরঝড়ের যুগ। এর আগে ছিল পতৌদি-দুরানি-বিশ্বনাথের “রোম্যান্টিক এরা”। কিন্তু শুরুতে “বল পড়ে, ব্যাট নড়ে কি নড়ে না”-র দমচাপা সুগন্ধে যে ফার্স্ট স্লিপের বাতাস ভারি হয়ে থাকে, তার জন্যে আমরা প্রণাম করলাম জয়সিমা ও গাভাসকার ও রাহুল দ্রাবিড়কে। এরা সমসাময়িক!

এমন স্লান্টিং ব্যাট, যে সামনের পায়ে ঝুঁকে খেললেও বল পিচে এক ড্রপ খেয়ে উইকেটকিপারের হাতে চলে যায়। দেখে আমাদের কী কুলকুলি! শুধু খেলা কেন হবে, জীবনই যেন অনন্ত। টার্গেট আছে, সময়সীমা নেই। বিবাহের সংজ্ঞা হল রাহুল দ্রাবিড় ক্রিজে গেছেন। সন্তানের জন্ম হল রান...বাট হোয়েন উইলিট টেইক প্লেইস! শুধু একের পর এক পুত্রকন্যাহীন ডেলিভারির কোলাভরি-ডি চলছে। আহা, তাড়াহুড়ো ক’রো না। আগে বাসন-ধোয়া, তরকারি-কাটা, মাছের আঁশ ছাড়ানো...তারপর তো উনুনে চাপাবো একটা জোরে পুশ, গ্যাপ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টাকে। হয়তো ছত্রিশটি বন্ধ্যা-বল শেষে স্কোয়্যার লেগ দিয়ে প্রথম সিঙ্গলস পরিবেশন, তারও ছ’বল পরে থার্ডম্যানে আর এক রান রচনা।

সত্যের যতটা সম্ভব কাছাকাছি ছিলেন তিনি। এবং ততদিনে সত্য অবসোলিট হয়ে গেছে। অথচ মুশকিল, রিটায়ার করার পরেও বেঁচে থাকার মতো, বুড়ো চুলের খুব পুরনো কোনও মানুষ রোব্বারের বাজারে হঠাত প্রকাশিত হওয়ার মতো, সত্যের স্লিপ-ডিস্ক ছায়াটা আমাদের টেনশান দিতেই থাকে। এখানে একখানি হাসি পরিবেশন করব। স্কুলবেলায় একটি মেয়ের জন্যে (ছেলে হলে “একটা” লিখতাম...দ্রাবিড় সভ্যতা) আমার হৃদয় কিছু গড়বেতা-কেশপুর করেছিল। গ্রামের পুকুরজলে তাই নিয়ে চ্যাংবাজির হপ-স্টেপ-জাম্পে গুজব ছড়িয়েছিল কি! এইরকম ছোট বিপন্নতার মধ্যে মাঝে-মাঝেই সত্যচরণ পালকে দেখতে পেতাম--- মেয়েটির বাবা--- সাইকেলে গ্যাস আনতে যাচ্ছেন বা বিকেলে পাশের পাড়ায় তাস খেলতে। দেখামাত্র আমার মনে অবধারিত ফিসফিস শুরু হতঃ সত্য কখনও চাপা থাকে না... ওই দেখো, সত্য ঠিক বেরিয়ে পড়েছে!

তিন
এই পৃথিবীতে কেউ কি কাউকে ইন্টারেস্ট-ফ্রি লোন দেয়, ভগবান ছাড়া? এবং তোমার ঝুপ-ঝুপ করে ঘাম ঝরে চেন্নাইতে মাথা-বুক থেকে, শীতের হাওয়ায় কোলকুঁজো পিঠের ভেতর শনশনিয়ে ঢুকে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। এবং যখন পৃথিবীর দ্রুততম আপেলটা তোমাকেই খেতে চেয়ে ঠোঁটের কান ঘেঁষে শিস কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন ক্রিকেট বোর্ড ক্যারাম খেলে, রেসের মাঠে বসে থাকে স্পনসর আর মিডিয়া মাল-টাল খেয়ে ঘুমিয়ে কাদা। কিন্তু তুমি পালটা মার দিয়ে বেরিয়ে যাও না তো! যেহেতু জেনেছ, প্রতি-আক্রমণ এক রকম পালিয়ে যাওয়াই...ছেষট্টি ফুট পিচ রাস্তায় গড়াতে গড়াতে, মহাত্মার চেয়েও গায়ে বেশি কালশিটে-মার নিয়ে, বস, তুমি বুদ্ধপুত্র --- “কালা কানুন”, “সাদা কানুন”, সব জ্বলাকে রাখ করে দাও।

ব্যাটিংসত্য তোমাকে যে সুদহীন ঋণ দিয়েছিল, তারই “বলবুতেঁ পর” চালিয়ে গেলে, হে উদাসী! আমাদের কোন কাকভোরে জীবিকা খুঁজতে বেরিয়ে যাওয়া জীবনে, আমাদের সেলসম্যান নসিবে দ্রাবিড় রয়েছে। ছুটে বাস ধরা, ঝুঁকি নিয়ে পেরিয়ে যাওয়া রেললাইনের ওপরেই বস্তির রেডিয়োয় রাহুল ৩৭ বা ৪৫ নট আউট। “ও-মাল যখন একবার সেট হয়ে গেছে...” ব’লে আমরা ব্রাশ মুখে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। হিস্টিরিয়া রুগির দাঁতকপাটি আর দ্রাবিড়ের ডিফেন্স, খোলো দেখি তুমি কতবড়ো পোস্তোর বড়া!

দর্জির কাঁচি দিয়ে সাঁই করে টেরিকটন দুভাগে কেটে ফেলা--- দ্রাবিড়ের কভার ড্রাইভ। আর আহা, ওই আছে-কি-নেই-কোমর মোচড়ানো কৌণিক পুল-এর আবেগ, লজ্জায় লিপস্টিক-লাল “ভাবতেই পারিনি” ছক্কাগুলো। যেভাবে টি টোয়েন্টির নাইট ক্লাবে সব ক’টা বাউন্সারকে নামালেন পায়ের কাছে, তাতে মনে হবেই, ক্ল্যাসিক ছাড়া এ-জীবনে অন্য কিছুর ধোঁয়া ছাড়েননি, এবং গানওনি রবীন্দ্র বাদে অন্য কাউকে --- “যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্ব-রানে”।

তোমার জন্যেই ছিল আমাদের লম্বা ঘাসে কিশোর-পা ডুবিয়ে বাউন্ডারিতে দাঁড়ানো, পেছনে পুকুর। দুপুরের ঝামা রোদে যখন ভুরু গলে গিয়ে নিজের ঠোঁটটাকে সামুদ্রিক ঝিনুক করে তুলেছে, একটা ছিটকে আসা ক্যাচের সাধনা তোমার জন্যেই, হে রাহুল। দেরিতে ভাঙা ইনস্যুইংগার ভয়ে ভয়ে ফ্রন্টফুটে যাওয়া গরীব ছেলের অরক্ষিত পায়ে পড়ে তাকে দোলের বেলুনের মতো ফাটিয়ে দিত আর সেই স্বেচ্ছা-রক্তদান শিবিরে তোমারই মুখ ভাসিয়ে রাখতাম মোরা সকলে।

টেকনিক্যালি বলতে গেলে রাহুল মানে সতর্ক আর দ্রাবিড় সাহসী ( আমার ব্যক্তিগত ডিকশনারির প্রথম পাতায় পাবেন। যেমন বীরেন্দ্র ছিল “চলাও বল্লা” আর সহবাগ “ভাবতে ব’য়ে গেছে”)। এখন ডাকাবুকো লোক কি সাবধান হয়, প্রশ্নটা সেমিনারের বিষয় হতে পারে। এবং এই যে কন্ট্রাডিকশান ইন টার্মস, ইহার কারণেই রাহুলের চোখ-মুখ সদা-ঘোলাটে। যেহেতু আত্মগোপনের দু-নম্বর নামও রাহুল দ্রাবিড়।

স্বপ্নে আমাকে অনেকবার তার ইন্টারভিউ নিতে হয়েছে। সব সময়েই কিছু না ক’য়ে সামনে দিয়ে সাদা ব্যাট হাতে হেঁটে চলে যেত --- সালভাদোর দালি। একবার শুধু একটা প্যারা দিয়ে বলে, ঘুম থেকে উঠেই লিখে ফেলিস কিন্তুঃ

“আমার কাছে যে-কোনও খোলা মাঠই ক্রিকেট। তার শিশির-শিবির ঘাসগুলো, সেখানে শুয়ে সামান্য ফ্রি হ্যান্ড, প্যাডের ফিতে বাঁধা --- সব কিছুই। আমার কাছে সারাদিন রোদে ঝামা-পোড়া হয়ে ফেরার পর মা’র ভার মুখটাই স্কোরবোর্ড, ভিন রাজ্যে ক্যাম্পে যাওয়ার সময় ওই চোখের ছলছলানি ছুঁয়ে ক্রিকেট ম্যাগাজিনের ছবিগুলো আরও বেশি রক্তমাংস। প্লেনে এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়ে যাওয়া ঘুমের মধ্যে মেঘের শরীরে লেগে থাকে আমার স্কোয়্যার কাট... আমার প্রেম, সন্তানের মুখ, সব ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভে আঁকা।"

এক মিনিট পজ দিলেন রাহুল।

"ক্রিকেট সাত অক্ষরের। হেভেন তার চেয়ে একটা কম....."

বোকা বোকা লম্বা (গল্প)

বোকা বোকা লম্বা

মা
শীতের সকাল। বারান্দায় গ্রিলের পাশে আমি চমৎকার রোদে ব’সে আছি। না না, রোদ্দুরটি সুন্দর তা বলিনি কিন্তু। চমৎকার আমার নাম, এ-গল্পও এক বেড়াল-ফ্যামিলির।
আজ মানুষের রোববার, কিন্তু বেড়ালের ক্যালেন্ডারে লেখা, “দেরিতে ব্রেকফাস্ট”। মনুষ্যজাতির মধ্যে যারা অফিসবাবু, ছুটির দিনে আটটার আগে তো বিছানা ছাড়েন না। আর সেই জন্যেই এখনও পর্যন্ত বিবিলের দেখা নেই, পাড়া টহল দিতে বেরিয়েছে। বাচ্চা মানুষ, স্যরি বেড়াল, খিদেও বেশি।
তবে শুধু বয়েসের দোষ দেব কেন, বিবিলের ফিগারটাও মাথায় রাখা দরকার। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কসরত করতে গেলেই তারা আমার কাছে এসে কমপ্লেন ঠোকেঃ তোমার ছেলেকে সামলাও। আমরা সব তিন কেজি বিভাগের কুস্তিগির, অথচ বিবিল সাড়ে পাঁচ কিলো চেহারা নিয়ে লড়তে আসছে। আমাদের ঘাড় মটকে যাবে না!
মনের এই হতাশায় বেচারা আরও বেশি মানুষ-ঘেঁষা হয়ে পড়েছে। আমাদের আস্তানা, মানে এই দত্তবাড়ির ছোট মেয়ে বুন্নি-র ল্যাপটপের দিকে সারাক্ষণ হাঁ ক’রে তাকিয়ে ব’সে থাকে। বুন্নি গেমস খেলতে খেলতে হয়তো জিগেস করল, “বল তো এবার কোন বাটনটা টিপতে হবে?” ওমনি সে উঠে যেতে গিয়ে অ্যাত্তোখানি পায়ের থাবায় ভুল বোতাম প্রেস ক’রে দেয়। বুন্নি হেসে ফেলে, “ তুই একইরকম থেকে গেলি, বোকা বোকা লম্বা, সংক্ষেপে বি বি এল, মানে...উঁ উঁ...আমার বিবিলসোনা।
.............
গল্প থামিয়ে চমৎকার উলটো দিকে ঘুরে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ল। তারপর পাঁচিলের ওপর দিয়ে এক দৌড়ে রান্নাঘরের সামনে। আজ এতো সকাল সকাল গ্যাস ওভেনে চায়ের জল চাপানোর শব্দ শোনা যায় কেন? এবার একটু পেছনে হেঁটে সে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায়। এটা বুন্নির ঘর। মেয়েটাও নেই বিছানায়। হয়তো কাল রাতে দোতলার স্টাডি রুমে আলো জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। দেয়াল-ঘড়িটা উল্টো দিকের দেয়ালে, দেখা যায় না। কিন্তু ঘন্টা পড়ছে। চমৎকার গুনতে লাগলঃ আউ, সাউ, চিন কিত, অন্তা, মিউ, পার...। হা ভগবান, সবে সাতটা বাজে! টোস্টের কয়েকটা পোড়া টুকরো, তিন-চারটে বিস্কুট, কিছুটা ছানা, ডিমের কুসুম একটুসফোঁটা --- এইমাত্র সকালের খোরাকের জন্যে আরও দেড়টি ঘন্টা চুপ ক’রে ব’সে থাকা পোষায়, বল তো!

ছেলে
আমার মা যেদিন মারা যায়, এ-পাড়ার সব মা-বেড়াল গোল হয়ে আমাকে ঘিরে ব’সে ছলছল চোখে মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি তাদের মধ্যে চমৎকারের কাছে গিয়ে ওর কোলে মাথাটা গুঁজে দিই। সেদিন থেকে চমৎকারই আমার মা, আর এই গল্পটাও আমরা মা-ছেলেতে মিলে-মিশে বলব।
যাই হোক, পাড়া ঘুরে দত্তবাড়ির পেছনের পাঁচিল টপকে নিমগাছের ডাল থেকে একলাফে নেমেই থতমত খেয়ে দেখি, ঠিক সামনে গৌরীশংকর দত্ত। কিন্তু আজ তার আমাকে তাড়া দেওয়ার মেজাজ নেই, জলের পাম্পের পাশে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে কী একটা খুঁজতে ব্যস্ত। পেরিয়ে যেতে যেতে শুনলাম, চেঁচিয়ে বলছেন, “আরিয়ান্তোসে ইকড়িমিং চাউতা”। না না, গৌরীকাকু বাংলাতেই বলেছেন কথাটা, কিন্তু আমরা বেড়ালরা তো আর বাংলা জানি না, বলি না, বা বুঝি না। অথচ আমরা বেড়ালরাই আবার পৃথিবীর সব ভাষাই জানি এবং বুঝি। আসলে বেড়ালের মস্তিষ্কের কোষে এমন এক অটোম্যাটিক অনুবাদ ব্যবস্থা রয়েছে যাতে যে কোনও ল্যাঙ্গুয়েজ বেড়ালের নিজস্ব ভাষা “মার্জারিক”-এ পালটে যায়। শুধু তাই নয়, মানুষ কোনও শব্দ উচ্চারণ করলেই তার মার্জারিক অনুবাদ মস্তিষ্ক থেকে স্পষ্ট উচ্চারণে আমাদের কানে পৌঁছোবে। ঠিক যেন মেট্রো রেলে ঘোষণা হচ্ছে, “অগলা স্টেশন গিরীশ পার্ক”। যাই হোক, “আরিয়ান্তোসে ইকড়িমিং চাউতা” মানে হল, কাগজটা তো এখানেও নেই।
রোববারের সাত-সকালে বাড়িসুদ্ধ লোক উঠে পড়ে কী খুঁজছে তাহলে? ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেব ভাবছি, আমার মা রান্নাঘরের জানলার নিচ থেকে ঠোঁট চাটতে চাটতে বেরিয়ে এল। এসেই যথারীতি বকুনি, “কোথায় চরতে গেছিলি, হতচ্ছাড়াটা? এখন বেলা দুটো পর্যন্ত খালি পেটে ঘুরে বেড়াও গে”। তারপর গলা নামিয়ে বলল, “ বুন্নি আর ওর বাবা কলকাতায় যাবে। মেয়েটার কী যেন পরীক্ষা আছে”।
---রবিবারে পরীক্ষা!
--- তাই তো বলল, “ইগুতিনো আঙরাসু চিয়াং ডলুমি”। কিন্তু বুন্নি “আডমিটিকার” খুঁজে পাচ্ছে না ব’লে হুলুস্থুল। সে আবার কী জিনিস রে!
আমিও তো জানি না। মনে হচ্ছে, শব্দটা গ্রীক বা ইতালিয়। মুশকিল হল, আমাদের ব্রেইন এখনও ততো উন্নত হয়নি ব’লে কেউ দুটো ভাষা মিশিয়ে কথা বললে শুধু প্রধান ভাষাটার অনুবাদই কানে পৌঁছোয়।
............
কিছু ক্ষণ চুপচাপ দুই থাবার মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে থাকল বিবিল। তারপর হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গ’লে উঠোনে লাফিয়ে পড়ে তীরবেগে ছুট। “আবার কোথায় আড্ডা মারতে চললি?” ব’লে তার পেছনে হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়ল চমৎকারও।

মা
সরকারবাড়ির পুকুরে অর্ধেক জল, বাকি অর্ধেক ঢেকে গেছে কলমি-বেতো শাকে। সেখান থেকে ঢাল বেয়ে ওপরে উঠলে লম্বা ঘাসভরা জমি, মুখ না তুলে হাঁটো যদি, নাকে সুড়সুড়ি খেয়ে হাঁচি আসতে বাধ্য। তারপর বাতাবিলেবু গাছ একটা, যেখানে সোমঋতাদের দুধেল গরু আব্বুলিশ বাঁধা থাকে। জগন্নাথ সরকার বারাসাতে বাড়ি ক’রে ফ্যামিলি সমেত উঠে যাওয়ার পর এই সবুজ মাঠের টুকরোটা পাড়ার বেড়ালদের আড্ডা বা সেমিনারের জায়গা। বিবিল সেখানে দাঁড়িয়ে বারবার তাকাচ্ছিল কীর্তনবাড়ির দিকে। মিনিট খানিক পরেই, ঠিক যা ভেবেছি, সে-বাড়ির গেট পেরিয়ে দিশা মেয়েটা এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে সুড়ুত করে কাঠটগর গাছের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।
দিশার পুরো নাম অনেকগুলো সিংঘে, নায়েকে, আর্থার, পেরেরা দিয়ে বানানো, তিংসা বগির ট্রেনের মতো (তিংসা মানে বারো)। ও আসলে শ্রীলংকার খ্রিস্টান বেড়াল, কলোম্বোর বিখ্যাত উকিল মেন্ডিস পেরেরার কাছে মানুষ হয়েছে। ওই বাড়িতেই দুবছর ভাড়া ছিলেন কীর্তনবাড়ির ডক্টর রামবিলাস কীর্তনিয়া। দেশে ফেরার সময় বাচ্চাটাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন।
কাঠটগর-বন পেরিয়ে জামরুল গাছের আড়াল দিয়ে দিশা খুব জোরে ছুটে এল মাঠটুকু। তারপর বিবিলের নজরে আসার ঠিক আগে থেমে গিয়ে হেলেদুলে হাঁটতে লাগল। মুখের আহ্লাদি ভাব লুকিয়ে চোখদুটো উদাসীন-মতো করে বলল, আবার কী হ’ল? ডাকছিলিস কেন!
---এই, “আডমিটিকার” মানে কী রে?
মেয়েটা তো হেসেই বাঁচে না। “ওটা অ্যাডমিট কার্ড, ওতে রোল নম্বর, ছবি, সব দেওয়া থাকে। না নিয়ে গেলে পরীক্ষার হলে ঢুকতেই দেবে না। আমাদের বাড়ির বন্দনাদিও ন’টা বেয়াল্লিশের ট্রেনে যাচ্ছে, ওর আবার বিধাননগর কলেজে সিট পড়েছে তো!
আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে রোদের হেলানো রশ্মি দেখতে পেলাম। মনে মনে অল্প একটু পরিমিতি ক’ষে নিয়ে বললাম, আর ঠিক আধ ঘন্টা বাকি। কিন্তু এখন আমাদের আর কী-ই বা করার আছে!
আছে অনেক কিছু। বুন্নিদির অ্যাডমিট কার্ড আমি গতকালই দেখেছি ওর হাতে। নিশ্চয়ই ওই ঘরের মধ্যে কোথাও....।
বিবিল যেন কুকুরের তাড়া খেয়েছে, শরীরটা এমন ছোট্ট করে ছুট দিল দত্তবাড়ির দিকে। দিশা চেঁচিয়ে বলল, “ঝামেলা মিটল কিনা বিকেলবেলা এসে জানিয়ে যাস”। তারপর আমার দিকে চোখ পড়তে থতমত খেয়ে ক্যাবলার মতো হাসল, “আপনিও আসবেন, কাকিমা”।
কিন্তু সেসব দেখার সময় নেই এখন। প্রাণপণ দৌড়ে বড়রাস্তা লাগোয়া কচুবাগানের কাছে ধরে ফেললাম বিবিলকে।
তোর কি মাথা খারাপ হল যে মানুষকে সাহায্য করতে ছুটছিস! ওরা এক্ষুনি বুঝতে পেরে যাবে আমরা বাংলা ভাষা জানি। তারপর বাকি জীবন কুকুর হয়ে কাটাতে পারবি তো?
একটা অ্যাডমিট কার্ড খুঁজে দিলাম, আর এতকিছু ঘটে গেল!
শোনো, তোমারই মতো বোকা একটি সারমেয় মানুষের কথা শুনে একবার শুধু আহ্লাদে লেজ নেড়ে ফেলেছিল। বাকিটা ইতিহাস। এখন কুকুরদের সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দিয়ে আবার ভোরের আলো ফুটতেই বাড়ির বুড়োবুড়িকে মর্নিং ওয়াকে নিয়ে ছুটতে হয়। তারপর সকালের খবরের কাগজ মুখে করে নিয়ে আসা থেকে বাজারের ব্যাগ বওয়া, দুপুরে বৌদি ঘুমোলে বাচ্চার নজরদারি, দুবেলা বাড়ির ছোটদের সঙ্গে ফুটবল প্র্যাক্টিস ---এসব তো আছেই। রেডিও-টিভিতে, সিনেমায়, এমনকি মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে পর্যন্ত খাটছে কুকুর, অথচ কোনও কুকুরের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির লিস্টিতে একটা নোকিয়া বা স্যামসাং বা এলজি-র চোদ্দশো টাকার সেট-ও খুঁজে পাওয়া যাবে? আর, সবচেয়ে দুঃখের কথা কী জানিস? পুলিশ-মিলিটারিতেও কুকুর গিজগিজ করছে। মানুষ নিজের কাজ করাচ্ছে কুকুরকে দিয়ে।
আবেগে চোখে জল এসে গেছিল। বিবিল পেছনের দরজা দিয়ে দত্তদের ঘরে ঢুকে তক্ষুনি বেরিয়ে এসে বলল, কেন, ওরা মোটা মাইনেও তো পায়? তাছাড়া কুকুর কতো বিশ্বাসী প্রাণী সেটা বল? পেট ভরা থাকলে রান্নাঘরে ঢুকে খাবারে মুখ দেবার কু-স্বভাবটা নেই।
শুনে মেজাজ এত গরম হয়ে গেল, বাঁ হাত তুলে ওর মাথায় এক থাবা বসালাম, “জিভ খসে পড়বে নিজের জাতের বদনাম করিস তো। আমাদের দেবতা বেড়াদাস বলেছেন, চুরিই হচ্ছে খাঁটি বেড়ালধর্ম। বুঝলি ইঁদুরটা!
আমার অতশত বুঝে-সুঝে কাজ-টাজ নেই। বুন্নিদি আমাকে ভালোবাসে। দিদি পরীক্ষা দিতে না পারলে খুব কষ্ট হবে, ব্যাস।
দেখলাম, বিবিল দত্তভিলার পেছন দিকটায় চলে গেল। তার মানে পেঁপে গাছ বেয়ে ছাদে উঠে স্টোররুমের ফোঁকর গলে দোতলায় ঢুকে তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবে। যে মানুষ ওকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই তাড়িয়ে দেয়, উনি চললেন তাদের উদ্ধার করতে। হুঁহ!

ছেলে
শুনেছি, এর আগে তিন দফায় আমার মোট পাঁচটা দাদা-দিদি হয়েছিল। মা তখন যে বাড়িতে, সেই হালদারবাবুরা আড়াল দিলে ওরা হয়তো শেয়ালের পেটে যেত না। তারপর থেকেই মা একটু মানুষ-বিরক্ত। যাহোক, অনেকদিন পরে স্টোররুমে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। এই ঘরই আমার জন্মস্থান কিনা! ওই তো সেই প্লাইউডের বাক্স যার মধ্যে খেলা করে আমার “বৈশব” (বেড়ালের শৈশব আর কি) কেটেছে। কিন্তু পুরনো খবরের কাগজ লাট করে রাখার জায়গাটা যেন কোথায়? বুন্নিদির খাটের ওপর বইপত্র আর খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে বসার ওভ্যেস। অ্যাডমিট কার্ড বইয়ের সঙ্গে উঠে গিয়ে থাকলে এতক্ষণে শেলফ ঘেঁটে খুঁজে পাওয়ার কথা। কিন্তু রাঁধুনি নিরুমাসি বা অন্য কেউ যদি পেপারের সঙ্গে তুলে ফেলে? কাগজের স্তূপ থেকে এক একটা করে কামড়ে নামিয়ে ফের মুখে তুলে ঝাঁকাতে লাগলাম। নাহ, কিচ্ছু নেই, শুধু ধুলোয় গা-মাথা ভরে গেল। হঠাৎ মনে হল, নতুন কাগজের ডাঁই হলে তো এত ধুলো জমার কথা নয়! দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছি, বুন্নিদির গলায় চাপা কান্নার আওয়াজ! ইস, মা মারা যাওয়ার পর আমাকে তুলোয় করে দুধ খাইয়ে বাঁচিয়েছে যে, সেই দিদিটার জন্যে কিছুই করতে পারব না! ঠিক এমন সময় সিঁড়ির ঠিক নিচে গৌরীকাকুর সাইকেল আর গ্যাস সিলিন্ডারের মাঝখানটায় চোখে পড়ল, আরও কিছু খবরের কাগজ ভাঁজ করে সাজানো, আর তার প্রথমটা ধরে টান দিতেই নিচে থেকে বুন্নিদির ছবি বেরিয়ে এসেছে। অ্যাডমিট কার্ড মুখে করে ছুটতে যাচ্ছিলাম ও-ঘরে, মনে পড়ল মা-র সাবধান-বাণী! আমাদের ধর্মগ্রন্থ (পড়ব পড়ব করে আর পড়া হয়ে ওঠেনি) “বেড়াভাগবতে” নাকি লিখেছে, বেড়ালের বুদ্ধির কথা জানতে পারলে মানুষ তাদের রকেটে করে মহাশূন্যে পাঠিয়ে দেবে। আর সেখানে তাদের গায়ের লোম ঝরে গিয়ে চেহারাটা ঝাঁটার শলার মতো হয়ে উঠলে নিজেরাই নিজেদের তেলাপিয়া মাছের কাঁটা ভেবে খেয়ে ফেলবে তারা। আমি অ্যাডমিট কার্ডের ওপরে বসে পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগলাম। গৌরীকাকু এসে “সোবাতাং জিয়াও মুনি” (বাড়ি মাথায় করেছিস কেন?) বলে ঝুলঝাড়ু দিয়ে জোরসে পিঠের ওপর একখানা কষিয়ে দিল। কিন্তু ভয় পেলে সাহসের কাজ করা চলে না। আমি চিৎকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দেওয়ামাত্র শুনতে পাচ্ছি তরুকাকিমার গলা, “বেজিনা লুসিও। পিং সে কাই অরন তুদা।“ (তুমি পারবে না। গায়ে জল ঢেলে দিলে ও শায়েস্তা)। এই রে, পরীক্ষার প্রবেশপত্রও যে ভিজে সপসপে হয়ে যাবে! তরুকাকি এলে তেড়ে যাব কিনা ভাবছি, বুন্নিদি এতক্ষণে সিঁড়ির ঘরে ঢুকল, সব সময় একটা অবলা জীবের পেছনে লেগে আছো কেন! সকালে খেতে পায়নি বলে চিৎকার করছে সেটাও বুঝলে না?
“ইচিদং ত্রামে সোহা” (তোর জন্যেই এটা মাথায় উঠেছে) বলতে বলতে দুজনে বেরিয়ে গেলে আমি মেঝেয় পড়ে থাকা অ্যাডমিট কার্ডটার চারপাশে পাক খেতে লাগলাম। বুন্নিদি তক্ষুনি লাফিয়ে এসে কাগজটা তুলে নিয়ে একদম অবাক হয়ে গেছে। “কোথায় পেলি এটা? এত বুদ্ধি তোর! এবার তো সিসিল বলে ডাকতে হবে ওস্তাদকে, মানে চালাক-চালাক-লম্বা! আমার কিন্তু প্রথম থেকেই সন্দেহ হত বাংলা ভাষাটা তুই কব্জা করে ফেলেছিস...হ্যাঁ রে, হাঁ করে দেখছিস কী?

আমার মাথার অনুবাদ-যন্ত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। বুন্নিদির কথা শোনামাত্র বুঝে ফেলছি আমি। তার মানে মানুষই হোক, বা পশু-পাখি বা গাছপালা, ভালোবাসার ভাষা সবার বেলাতেই এক। একজনের মুখ ফুটলেই আরেকজন টের পেয়ে যাবে। এমনকি উচ্চারণ করারও দরকার নেই। যেমন বুন্নিদি এখন আমার গলায় সুড়সুড়ি দিতে দিতে মনে মনে বলছে, কিন্তু তুই ইংরিজি কী করে শিখলি, বিবিল? নিশ্চয়ই তোর সেই শ্রীলংকান বান্ধবীর কাছে!