Monday 18 August 2014

সরি-গেট আর সিগারেট

চন্দন ভট্টাচার্য




 
চন্দন ভট্টাচার্য

জন্মঃ         ১৯৬০
বইপত্রঃ    জাতকের কবিতা (কবিতা পাক্ষিক)। তিনটি ডানার পাখি (সপ্তর্ষি)। জগৎমঙ্গল কাব্য (সপ্তর্ষি)। লাশফুল ফুটিয়েছো (গ্রন্থি)। নবরত্ন কারাদণ্ড সবুজ (গ্রন্থি)। কবিতাসংগ্রহ ১ (গ্রন্থি)। ভুবনভোজন চলছে (গ্রন্থি)। ছোট পুষ্পবৃষ্টি হোক (সপ্তর্ষি)।
যোগাযোগঃ  ৯৩৩১২৪৯৯৪০


সরি-গেট আর সিগারেট    

সরি ছিল একটা পেইন কিলার। তবে ফিরি-তে বিক্কিরি। না, সরকারি হাসপাতালের ত্রিসীমানায় সরি পাওয়া যেত না।  সরকার বিলোয় বন্ধ হওয়ার জিনিস, পোলিও, গর্ভএইসব।  সরি বরং দেয়াল মুছে দিতঃ নিখরচায় চক্ষু অপারেশন। 

সরির ক্লাসমেট সিগারেট। মাথা ধারালো,  তবে সিগারের (বাপের নাম) পয়সা ছিল বলে একটু উড়ুক্কু  স্বভাব। সময়টা জানা আছে তো? হ্যাঁ, বালাই-ষাটের দশক। দুজনে এক স্কুলে যায় একই ইউনিফর্মে --- সাদা শার্ট সাদা প্যান্ট, বাদামি জুতো। অথচ দু-বন্ধুর স্বভাব আলাদা। মা বারবার বলতো, সরি-কে দেখে শেখ, কত ধৈর্য, ক্লাস পালায় না, সন্ধের মধ্যে বাড়ি ঢুকছে। শুনে সিগারেটের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে।

সরি অবশ্য ধোঁয়া দেখেই আস্তানা পালটেছে --- অন্য মহকুমা, অন্য কলেজ। পড়াশুনোয় ডুবে যেতে হবে। সে তখনও বেশ কিছুটা সংখ্যালঘু।

রোয়ান অ্যাটকিনসন করেছিলেন ব্রিটিশ টেলিভিশনে.একটা লোক যে হাঁটতে-চলতে গিয়ে ঘরের দরজার সঙ্গে ধাক্কা লাগলে দরজাটাকেও সরি বলে। একে বহুদিন হল আমি দুঃখপ্রকাশের উচ্চতমবিন্দু মেনে নিয়েছি। ঠিক তেমনি একটা সিগারেটের চূড়া সেখানেই, যেখানে তাতে  স্ফুলিঙ্গ ছোঁয়ানো হয়নি। এমন চরিত্র টিভি নয়, বন্ধুর বাবা-তে দেখেছিলাম যিনি হাতের দু-আঙুলের ফাঁকে একটা গোটা অক্ষত ক্যাপস্টান নিয়ে ঘুরতেন।  গল্প-আড্ডা চলছে, দেশলাইটা ঝক-ঝক করে বাজাচ্ছেন টেবিলে, কোলের ওপর, কিন্তু ধরানো হচ্ছে না সিগারেট। যেহেতু, কাজে লাগাতে গেলেই ক্রমাগত ওর ক্ষেত্রটা ছোট হয়ে আসতে আসতে একসময় একেবারে হাপিস, মানে ফাঁচোট-এর প্রতিশব্দ হয়ে যাবে

যাহোক, কলেজ পালটানোর পর দুটো আলাদা পৃথিবীতে দুজনের বেড়ে ওঠা। মাস্টার্স করে  সোশাল সাইকোলজির ছাত্র হিসেবে সরি নিজেকে ইংল্যান্ডে সরিয়ে নিল গবেষণার কাজে। সেখানে একের পর এক পেপারে প্রমাণ করে চলল,  জাপানিদের অতিথি স্বাগত করার ধরণ থেকে খেতে বসা --- পুরোটা সরি-আধারিত। বুদ্ধ-মহাবীর থেকে যিশু, গুর্ডযেইফ হয়ে এম কে গান্ধী পর্যন্ত সরি-র এয়ার টু সারফেস মিসাইল ছুটছে। শুধু তাই নয়, ইরানে ড্রোন হানা আর আদিবাসী-ধর্ষণে  এক্ষুনি-ব্যবস্থা হিসেবে সরির প্রয়োগ নিয়ে কোনও কথা হবে না  গবেষণায় আরও বেরিয়ে এল যে (গবেষণায় কিছু ঢুকে যায় না কিন্তু কোনওদিন, ভারি আশ্চর্য), সরি নিচে থেকে ওপরে গেলে যতোটা, তার চেয়ে অন্তত ৫০ ভাগ বেশি কার্যকরী যখন সে ওপর থেকে নিচে বইছে
  
সিগারেটের মুশকিল ছিল বেশি  ছ্যাঁকা দেওয়ার কাজে ছ্যাঁকা খাওয়ার ঝুঁকি থাকেই (পরে অবশ্য আবিষ্কার করা গেছে যে ড্রাই আইস-এর মতো শীতল আগুনও পাওয়া যায়, ভৌত-রাসায়নিক শর্তগুলো পালটে দিলে)। কিন্তু তখনওযে-কোনও সিগারেটের নামের মধ্যেই একটা চ্যালেঞ্জঃ চার মিনার কিম্বা পানামাহয় চড়ে দেখাও, নয় সাঁতরে পার করো

বাংলার মাটিতে সরির সবচেয়ে বড় নির্মান নিশ্চয়ই উত্তমকুমার। সর্বাপেক্ষা বড় লগ্নী ও সেই পরিমাণে বক্স অফিস।  উত্তম দুঃখিত.....নিজের বা অন্যের ওপর। সন্ন্যাসী রাজা-য় সে  যখন মাটিতে বসে --- পা দুটো ভাঁজ করে বাঁদিকে  রাখা, ঠিক দন্ত্য স-এর শুঁড়, আর ডান হাত মাটিতে ঠ্যাকনা, ওই স-এর দাঁড়ি। অথবা ভাবুন, বাবার সামনে উত্তমকুমার মাথা নিচু, দুহাত পেছনে,  শুধু দুপায়ের গোড়ালি একযোগে সামান্য উঁচু হয়ে কথা বলে। সে মায়ের কাছে হালকা অভিমান, আর নায়িকাকে ভদ্র-বড়লোক ভিলেনের হাতে ছেড়ে নিজের শরীরের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়াতে বাড়াতে  অন্ধ বা টিবি-রোগি।  এবং এই ভাবেই সবারসহানুভূতি কুড়িয়ে নায়ক যখন, তাকে সিগারেটের মুখোমুখি ফেলে দিলেনসত্যজিৎ। সরি-র গাড়ি থামিয়ে সিগারেট তাকে নেমে এসে শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়াতে বলে। কিন্তু ততদিনে সরি রাজত্ব বিস্তার করে ফেলেছে...মেনে নেওয়ার, মেনে নিয়ে লেগে থেকে লড়ে গিয়ে দুঃখিত, প্রতিষ্ঠিত  ও একা হওয়ার সাম্রাজ্য!
   
এভাবে এগোতে থাকলে সরি যে একদিন জাতীয় জ্বালানির সম্মান দখল করেনেবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! বেশ কয়েক বছর আগে থেকে বনগাঁ কি কৃষ্ণনগর লোকাল সরি ছাড়া এক পাও এগোতে পারছে না। র‍্যাশন দোকান বা ক্রিকেট মাঠের টিকিটের লাইন থেকে শুরু করে অফিসে বস-এর চেম্বার পর্যন্ত প্রতিদিন কত সম্পর্ক আর জাতীয় গড় আয়কে যে সরি গ্রেসমার্ক দিয়ে পাস করিয়ে দিচ্ছিল!
অথচ এই রিলেশান-খাতেই সরির অ্যাবোলিশান।

ততদিনে সিগারেট কাউন্টারনির্ভর গণদহনে বিড়ির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সফল এনকাউন্টারের ভেতর দিয়ে ক্ষমতায় উঠে এসেছে, আর তার কিছুদিনের মধ্যেই সরি-কে টেনে নামিয়েছে গালাগালির পর্যায়ে। নিচে থেকে সরি-র ওপরে ওঠাটা একেবারে বন্ধ, জলপ্রপাত ক্রমাগত খাদের দিকে আর সেটাই তো সাফল্য সিগ-ভাইদের   

তবু, এটা ছিল বাইরের কষ্ট সরি প্রথম প্রত্যাখ্যান পেল প্রেমের কাছে, যত মিষ্টি, যত আদর-ধাক্কাই হোক না সেটা। একদিন হঠাৎ যেই এরিক সেগালের নায়িকা বলে দিলেন, লাভ মিনস নেভার হ্যাভিং টু সে ইউ আর সরি, প্রেমিকের  সরিটোটাল-বন্ধ এরপর, ঠিক যেভাবে স্বয়ংক্রিয় হাত এসে লেদ মেশিনের কাম তামাম করে দেয়।  এবং প্রেমিকা  কখনও ভুল করে দুঃখিত বলে ফেলতে গেলে অন্যজন তার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরে, তুমিই না বলেছ, লাভ মিনস নেভার.....। লাও ঠ্যালা!

এদিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা এগিয়ে চলেছে যেহেতু সিগারেটের ছেলেমেয়েবৈজ্ঞানিক, এবং যেহেতু বিজ্ঞানের শ্রেণীচরিত্র নাই --- হঠাৎ প্রমাণিত হল সিগারেট ক্যান্সার আনায় সক্ষম এবং আরও সমর্থিত খবর এই যে ক্যান্সার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।    

এই প্রথম সিগারেটকে সরি বলতে হল। নিজের শার্টে খুব অনিচ্ছেতেও আঁকল সরি, সিনেমার পর্দায় শুরুর আগে লিখে রাখল --- ঠিক যে প্রেক্ষাগৃহে দেরিতে পৌঁছে দর্শক কুঁজো ও অন্ধকার সরি-নামতা পড়তে পড়তে নিজের সিট খুঁজে নিচ্ছে। অনেক দশক পরে এবার পাশাপাশি চেয়ারে দুই বন্ধু, মিলন হল কতদিনে....!     

তখন সরি-র আইকনগুলো মড়মড় করে ভেঙ্গে পড়ছে একদিকে, আর সিগারেট বাবা-মা মারা গেলে মাথা ন্যাড়া না না-ন্যাড়া, এই প্রশ্নে নীতিগত অবস্থান চূড়ান্ত করতে ব্যস্ত। কিন্তু চুম্বকের দুই মেরু কাছে আসা মানে মৃত্যু দুজনেরই,ডাইকোটমি একমাত্র বিরোধিতাতেই বেঁচে থাকে। তাই মুক্কা পড়তে লাগল পরেরপর --- অফিসে সিগারেট খাবেন না, বউবাচ্চাদের সামনে বা বিশ্ববাজারে খাবেন না, ফ্যাক্টরি-মালিকের বিরুদ্ধে খাবেন তো না-ই!

উল্টোদিকে আরও কঠিন সরি-কেলেঙ্কারির প্রকাশ, যখন একটা মেয়ে ফেসবুকে তার বন্ধুকে (অ্যান্ড মাইন্ড ইট, বন্ধু; প্রেমিক নয়) জানিয়েছে, ছি ছি, দোস্তকেসরি বলতে হয়! বোঝা গেল, সম্পর্কের বাড়ি থেকে এবার বেরিয়ে আসতেই হবে সরি-কে, এবং সেটা ভেঙ্গে গজাবে নির্বিরোধ বহতল আনন্দ কমপ্লেক্স দুঃখ থেকে দুঃখিত সরে গেল, দুঃখ হয়ে উঠল ঝকঝকে ফিনিশড প্রডাক্ট একইভাবে, যদিওসিগারেট বন্ধ নয়, সিগারেট-টানা আটকে যাওয়াতে        না-হওয়া-বিপ্লবেরও দীর্ঘজীবী হতে বাধা থাকল না 

এখন স্থানহীন একটা স্থানাংক খুঁজছে দুজন; সমূহ বাস্তবতার মধ্যে, যেখানে মানুষ আর তার ইচ্ছে গরহাজির, যেখানে পণ্য আর পণ্যের আকাঙ্খা চালনা করে জনজীবন এই নিখুঁত ভারচুয়াল সমাজে।   

কিন্তু বদ্রিলার-বার্তসত্যে কি জীবন চলবে? চোরাস্রোত সমাজ-মননে নেই? দেখো, দ্বিত্ব ঠিক ঘুরে আসবে অন্য চেহারায়। দ্রাবিড়ের জায়গা নেবে চেতেশ্বর পূজারা, আর হজরতের পরে আকাশ তিন বছর বয়েসি প্রফেটকে পাঠালো, যে শাসিয়ে গেছে, I’m gonna tell God everything…. যার কথা আমিও লিখছি কদিন পরে, দাঁড়াও!     

No comments:

Post a Comment